একটি বিভ্রান্তকর সপ্তাহ শেষ করে নতুন সপ্তাহের প্রথম দিন পুঁজিবাজারে মূল্য সূচক কিছুটা বাড়লেও কমেছে বেশিরভাগ শেয়ারের দর। তারপরেও সূচকের উত্থানের মূল কারণ ওরিয়ন গ্রুপের তিনটি কোম্পানির বিস্ময়কর উত্থান পর্ব।
রোববার নতুন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ২০ পয়েন্ট। তবে ১০৯টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমে গেছে ১৪০টির দর। অন্যদিকে আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে ১২২টি কোম্পানির দর, সেগুলোর সিংহভাগই বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।
তিন মাসে ছয় গুণ বেড়ে যাওয়া কোম্পানির দর আবার বাড়ল একদিনে যতটা বাড়া যায় ততটাই। শতকরা হিসেবে অন্য আরেকটির দর বাড়তে পেরেছে আরও বেশি, কারণ এটির দর আগের সেই কোম্পানির তুলনায় কম।
তিন কোম্পানির মধ্যে ওরিয়ন ফার্মার দর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়ার সুযোগ ছিল। বেড়েছে ৯.৯৮ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ১১৬ টাকা ২০ পয়সা। বাড়ার সুযোগ ছিল ১২৭ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত। বেড়েছে ততটাই।
ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ছিল ৪৬৭ টাকা ৪০ পয়সা। বাড়ার সুযোগ ছিল ৫০৮ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। বেড়েছেও এতটাই। ঠিক তিন মাস আগে এই কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৮০ টাকা ৭০ পয়সা।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক শুরুতেই ৫২ পয়েন্ট বেড়ে গেলেও পরে সেখান থেকে ৩২ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ হয় লেনদেন
গ্রুপের আরেক কোম্পানি বিকন ফার্মার দর আগের দিন ছিল ৩২১ টাকা ৬০ পয়সা। বাড়ার সুযোগ ছিল ৩৪৯ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত। দিনের শেষ লেনদেন হয়েছে এই টাকাতেই। তবে সমন্বয় হয়ে দর দাঁড়িয়েছে ৩৪৮ টাকা ৭০ পয়সায়।
এদিন মোট ৯টি কোম্পানির দর দিনের সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে বা কাছাকাছি গিয়ে লেনদেন শেষ করেছে। এর মধ্যে তিনটিই ওরিয়ন গ্রুপের।
সূচক যে ২০ পয়েন্ট বাড়লেও ওরিয়ন গ্রুপের তিনটি কোম্পানির কারণে সূচকে যোগ হয়েছে তার মধ্যে বিকন ফার্মার একার অবদানই ২৮.৯৬ পয়েন্ট।
মোট লেনদেনের ১৬ শতাংশের বেশি কেবল একটি গ্রুপেরই। হাতবদল হয়েছে এক হাজার ৮১৩ কোটি ৯২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, এর মধ্যে ওরিয়নের তিন কোম্পানির অবদানই ২৯০ কোটির বেশি।
এর মধ্যে একক কোম্পানি হিসেবে লেনদেনের শীর্ষে থাকা ওরিয়ন ফার্মার ২২০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এই তালিকার চতুর্থ স্থানে থাকা ওরিয়ন ইনফিউশনে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা এবং বিকন ফার্মায় প্রায় ২৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
পুঁজিবাজারে ওরিয়ন গ্রুপের তিনটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত। তিনটি কোম্পানির শেয়ার দরই লাফাচ্ছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংশোধনে যাওয়া পুঁজিবাজারে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যে ধস নামে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু গত ৩১ জুলাই। এই কয় দিনে সূচক বেড়েছে ৫৫৪ পয়েন্ট। তবে এই সূচক বৃদ্ধির সুফল সমভাবে পড়েনি পুঁজিবাজারে। ৩০ থেকে ৩৫টি কোম্পানির উত্থানের কারণেই মূলত এটি হয়েছে।
এর মধ্যে শীর্ষে নিঃসন্দেহে ওরিয়নের তিন কোম্পানি। পাশাপাশি সূচকে ভূমিকা রেখেছে বেক্সিমকো গ্রুপের দুই কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মা, যেগুলোর দর গত কয়েক মাসে অনেকটাই কমে গিয়েছিল।
স্বল্প মূলধনি হলেই লাফাচ্ছে
ব্যাংক খাতের ৩৩টি কোম্পানির মধ্যে সিংহভাগ, ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে প্রায় সব কটি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, আর্থিক, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক এবং বস্ত্র খাতের বহু কোম্পানি ফ্লোর প্রাইসে আছে।
এর মধ্যে একক কোম্পানি হিসেবে টাকার অঙ্কে সব চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়া ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, শক্তিশালী মৌলভিত্তিক গ্রামীণ ফোনের মতো কোম্পানিও আছে। ওষুধ খাতে দেশ সেরা কোম্পানির একটি স্কয়ার ফার্মাও ফ্লোরের কাছাকাছি।
ভালো কোম্পানির ঝিমুনির মধ্যে এর ভিড়ে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলো লাফাচ্ছে।
ওরিয়ন গ্রুপের তিনটি ছাড়া আর যে ছয়টি কোম্পানি দিনের সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে থাকা স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকসের দর বড়েছে ৯.৯৯ শতাংশ। ৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা মূলধনের কোম্পানিটি গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান আছে ২ টাকা ২০ পয়সা।
তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ২ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান দেয়া ২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূলধনের ইস্টার্ন ক্যাবলসের দর বেড়েছে ৯.৯৮ শতাংশ। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ১৯৯ টাকা ৪০ পয়সা।
৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার লোকসানি কোম্পানি আজিজ পাইপের দর ৯.৫৪ শতাংশ, ৬ বছর পর উৎপাদনে ফেরার খবরে লাফাতে থাকা ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূলধনের জুন স্পিনার্সের দর ৮.৭৩ শতাংশ বেড়েছে।
ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া বিআইএফসি বছর তিনেক আগেও দুই টাকার ঘরে হাতবদল হতো। সেই কোম্পানিটি কেবল তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতেই দর ছাড়িয়েছে অভিহিত মূল্য। এই কোম্পানিটির দর বড়েছে ৯.৬২ শতাংশ।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে থাকা সি পার্ল, বিডিকম, বিডি থাইফুডের আর্থিক ভিত্তিও খুব একটা শক্তিশালী নয়। তাদের লভ্যাংশের ইতিহাসও তেমন একটা ভালো নয়।
লেনদেন বাড়লেও বহু কোম্পানির ক্রেতা নেই
বৃহস্পতিবারের তুলনায় এদিন লেনদেন বেড়েছে ৫৭১ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু তাতে ফ্লোর প্রাইসে থাকা শত শত কোম্পানিতে আগ্রহ বাড়েনি।
এদিন ১২টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি, চারটি কোম্পানির এক শটিরও কম, ৮টি কোম্পানির ৫০০টিরও কম, ছয়টি কোম্পানির এক হাজার থেকে দুই হাজারের মধ্যে, ১৪টি কোম্পানির ২ হাজার থেকে ৫ হাজারের কম, ১১টি কোম্পানির ৫ হাজার থেকে ১০ হাজারের কম, ১৩টি কোম্পানির ১০ হাজারের বেশি অথচ ২০ হাজারের কম শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
আরও ১০টি কোম্পানির ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজারের কম শেয়ার হাতবদল হয়েছে। আরও ২৫টি কোম্পানির ৫০ হাজারের কম শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ২০টি কোম্পানিতে এদিন হাতবদল হয়েছে ৮০৯ কোটি ২০ লাখ ৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে সবচেয়ে কম লেনদেন হওয়া এক শ টি কোম্পানি মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ৩১ কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
ব্র্যাক ব্যাংক, উত্তরা ফাইন্যান্স, ইউনাইটেড পাওয়ার, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির মতো ভালো কোম্পানির শেয়ারের বিপুল পরিমাণ বিক্রেতা থাকার পরও ক্রেতা পাওয়া যায়নি বললেই চলে।
পুঁজিবাজারের লেনদেন নিয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণত ফান্ডামেন্টাল শেয়ার বা যেগুলোর ভবিষ্যৎ ভালো সেগুলোর দাম বাড়ে। কিন্তু স্বল্প মূলধনি, লোকসানি বা ভালো ফান্ডামেন্টাল নয়, এমন শেয়ারের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
‘কিছু কারণে দর বাড়তে পারে। প্রথমত, হয়ত তাদের কাছে কোনো গোপন তথ্য আছে তাই ট্রেড করছে।
‘দ্বিতীয়ত, কোনো গ্রুপ ডিমান্ড ক্রিয়েট করা বা আকৃষ্ট করার জন্য ভলিউম বাড়াতে পারে। এসব কারণে হতে পারে। তাছাড়া আর কারণ দেখি না। তবে সাধারণ নিয়ম মেনে ভলিউম ভালো আছে বা ট্রেড হচ্ছে। ফলে ট্রানজেকশন ভালো আছে।’
খাতভিত্তিক প্রবণতা
খাত হিসেবে সবচেয়ে ভালো দিন গেছে সাধারণ বিমায়। এই খাতে ৪১টি কোম্পনির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৮টির। বাকি তিনটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
জীবন বিমা খাতের ১২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৮টির, কমেছে চারটির।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৮টির কমেছে একটির, বাকি দুটির দর কমেছে।
বাকি সব খাতে অল্প সংখ্যক কোম্পানির দর বেড়েছে, কমেছে বেশিরভাগ। আর মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে দেখা যাচ্ছে এক অদ্ভুত প্রবণতা। এই খাতে ৩৬টি ফান্ডের মধ্যে ৬টির লেনদেন হয়নি। বাকি ৩০টির সব কটির দর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে।
জুনে অর্থবছর শেষ করা ফান্ডগুলোর লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট শেষে সবগুলো ফান্ড ফ্লোর প্রাইসে নেমে এসেছে। কিন্তু এই দরে লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে।
লেনদেনে এদিন সবাইকে ছাড়িয়ে ওষুধ ও রসায়ন খাত। হাতবদল হয় ৩৯৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকার শেয়ার।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিবিধ খাতে হাতবদল হয়েছে ২৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রকৌশল খাতে হাতবদল হয়েছে ১২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, চতুর্থ অবস্থানে থাকা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে লেনদেন হয়েছে ১১৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। কিছুদিন আগে প্রায় পাঁচ শ কোটি টাকা ছুঁইছুঁই লেনদেন হওয়া বস্ত্র ছিল পঞ্চম স্থানে। লেনদেন হয়েছে ১০৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সবচেয়ে কম লেনদেন হওয়া মিউচ্যুয়াল ফান্ডে হাতবদল হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা।
এদিন লেনদেনের শীর্ষ দশে ছিল যথাক্রমে ওরিয়ন ফার্মা, বেক্সিমকো লিমিটেড, জেএমআই হসপিটাল, ওরিয়ন ইনফিউশন, ইস্টার্ন হাউজিং, জেনেক্স ইনফোসিস, বিডিকম, ইউনিক হোটেল, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং লাফার্ম হোলসিম সিমেন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে ছিল স্টান্ডার্ড সিরামিকস, ইস্টার্ন ক্যাবলস, সি পার্ল, বিডিকম, ওরিয়ন ফার্মা, বিডি থাই ফুড, বিআইএফসি, আজিজ পাইপ, বিএনআইসিএল ও জুন স্পিনার্স।
দরপতনের শীর্ষ দশে ছিল যথাক্রমে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, জেএমআই সিরিঞ্জ, অ্যাপেক্স ফুড, সোনালী পেপার, আইপিডিসি, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, মুন্নু অ্যাগ্রো, সোনালী আঁশ, সিনোবাংলা ও সিভিও পেট্রোকেমিক্যালস।