‘দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অনেক কিছুই করতে চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে তা করতে পারব না। কারণ অনেক কিছুই প্রস্তুত নয়।’
দেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম একথা বলেছেন।
রাজধানীর একটি হোটেলে শনিবার সকালে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএসইসি চেয়ারম্যান।
ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে।
শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম। মাঠে এসে দেখছি বইয়ে লেখা নিয়মকানুন সব জায়গায় পালন করা যায় না। বুকসের অ্যাপ্লিকেশন অনেক সময় করা যায় না। বাস্তবতার নিরিখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি অনেক কিছুই করতে চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে বা দুই বছরের মধ্যে তা করতে পারব না। অনেক কিছুই প্রস্তুত নয়।’
ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি যদি না থাকে কাজ করা না যায়।
‘ডেরিভেটিভস মার্কেট নিয়ে কতটুকু এগুতে পারব? কয়টা লোক এর মানে বোঝে? এই জিনিসটা যে কী, কী করতে হবে, দেশের পয়েন্ট ০১ শতাংশ মানুষও কি সেটা জানে। তাহলে কীভাবে ডেরিভেটিভস মার্কেট নিয়ে কাজ করব?’
লিটারেসি না থাকায় দক্ষ লোক পাওয়া যায় না বলে উল্লেখ করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। বলেন, ‘আমি যেখানেই কাজ করতে যাই, ডিজিটাল বোর্ড নিয়ে, আইটিতে লোক পাই না। আমি অফশনাল ডেরিভেটিস নিয়ে কাজ করছি, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নিয়ে কাজ করছি চিটাগংয়ে, আরইআইটি নিয়ে কাজ করছি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। কিন্তু কই, লোক তো পাচ্ছি না! যদি কাজ করারই লোক না থাকে তাহলে কে করবে এগুলো? এই মার্কেটে প্লে করবে কারা? তাই লিটারেসি নিয়ে আমাদের প্রথম কাজ করতে হচ্ছে।’
শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘অনেকেই অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুলনা করেন। কাদের সঙ্গে করেন সেটা কিন্তু আগে দেখতে হবে। যে মার্কেটে লোন ও সেভিংসের ইন্টারেস্ট রেট ১, ২, ৩ বা ৪ শতাংশ, সেই ইকনোমির সঙ্গে যদি আমাদের তুলনা করেন তাহলে কী করে হবে?’
তিনি বলেন, ‘সেখানে তাদের আর অপশন কী? যারা সঞ্চয় করে, বিনিয়োগ করে, তারা বেস্ট রিটার্নের জন্য করে। তারা কোথায় যায় তখন? একটা অপশনই তাদের সামনে খোলা থাকে। দেশ-বিদেশে বিনিয়োগ বা নিজের দেশের ক্যাপিটাল মার্কেট যেখান থেকে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়, সেদিকে যায়।’
বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘আমাদের দেশের এখনকার যে অবস্থা তাতে আমাদের এফডিআর রেট ৭ শতাংশের কাছে, আমাদের লোনের রেট ৯ শতাংশের আশপাশে এবং আমাদের ইনফ্লেশন রেট এখন ৬ শতাংশের আশপাশে।
‘এরকম সিচুয়েশনে আমরা যাকে অপরচুনিটি বলি, সেই অপরচুনিটি অব ইনভেস্টমেন্ট কোথায় আছে সেগুলো তুলনা করার আগে দেখে নিতে হবে।’
অন্য বাজারের তুলনায় দেশের পুঁজিবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘খায়রুল স্যার বলেই দিলেন, ভারতেও কিন্তু ৪০ শতাংশ শেয়ার ফেসভ্যালুর নিচেই লেনদেন হচ্ছে। সেখানে কি জাঙ্ক শেয়ার নেই? কয়টা কোম্পানি বন্ধ হচ্ছে, কয়টা কোম্পানি মার্কেট থেকে বিদায় নিচ্ছে? একটু তুলনা করে দেখুন, আমরা ভালো করছি না ওরা ভালো করছে।’
‘আমরা ক্রিটিসাইজ করব নিজেদের ভালোর জন্য। তার আগে আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে যে আমাদের তুলনা কার সঙ্গে হচ্ছে এবং আমাদের বাস্তবতা কোথায়?’
পুঁজিবাজারের আকার জিডিপির ৫০ শতাংশে উন্নীত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘মার্কেট শেয়ার নিয়ে কথা আসছে। ১৬ বা ১৭ শতাংশ যাই বলুন, এটা নিয়ে সবাই তুলনা করে; অন্য মার্কেটে তো শুধু ইক্যুয়িটি নিয়ে হিসাব হয় না। সেখানে ডেট, কমোডিটি যত ইন্সট্রুমেন্ট ট্রেড হয় সেগুলো নিয়ে হয়।
‘এ মাসেই ইনশাআল্লাহ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যদি রেডি হয়ে যায়, সরকারি সিকিউরিটিজগুলো আসছে, সেদিনই তো ২৫ শতাংশে চলে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যেভাবে সহযোগিতা করছে, তাতে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পারপেচ্যুয়াল বন্ড, সাব-অর্ডিনেট বন্ড, সবকিছু ট্রেড করা শুরু করব। তখন তো এটা ৫০ শতাংশের কাছে চলে যাবে।
‘সুতরাং হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা যে জিডিপির সঙ্গে তুলনা করছি, তার কাছাকাছি না হলেও আমাদের বড় ধরনের পরিবর্তন এই বছরের মধ্যেই দেখতে পাবেন।’
ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড সম্পর্কে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘অনেক নতুন ও ইনোভেটিভ প্রোডাক্ট এসেছে। ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডই তো একটা ইনোভেটিভ প্রোডাক্ট। যে ডিভিডেন্ড মানুষ পেত না, দেয়া হতো না; এটা যে হিসাব করে শুরু করা হয়েছিল, ২০ হাজার কোটি টাকা, সেটা ডিক্লেয়ার করার পর দেখি ডিভিডেন্ড বন্টন শুরু হয়ে গেছে। দেখুন, কীভাবে বাড়ি বাড়ি ডিভিডেন্ড চলে যাচ্ছে।’
বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চাইলে তৎক্ষণাৎ সাজার আওতায় আনা যায় না বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক শিবলী। তিনি বলেন, ‘একজন জুয়াড়ি ধরতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। আমরা তখনই ধরতে পারি যখন স্টক এক্সচেঞ্জ তদন্ত রিপোর্ট দ্রুত দেয়। তারপর নিয়ম অনুসারে তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে শাস্তি দিতে ছয় থেকে এক বছর সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বিনিয়োগকারী ও বাজারের যা ক্ষতি করার তা করে ফেলে।’
গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যখনই আপনারা কারসাজির কোনো তথ্য পান, দ্রুত লিখে দেবেন। বিনিয়োগকারীদের সচেতন করবেন।’
‘অর্থ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার বিষয়ে সব সময় সচেতন। ওনাকে পুঁজিবাজারের কোনো বিষয় নিয়ে এসএমএস করলেও সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন। এরকম একজন লিডার থাকার পর মার্কেট নিয়ে চিন্তা করার কোনো কিছু নেই।’
সেকেন্ডারি মার্কেটের উন্নয়নের সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টিও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে উল্লেখ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা গত দু বছরে ৩৬টি কোম্পানির আইপিও দিয়েছি। এই সময়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
‘আমাদের ১৮টি বন্ধ কোম্পানি ইতোমধ্যে পুনরায় চালু হয়েছে। এই কোম্পানিগুলোর ব্যাংকের যে ঋণ ছিল সেগুলো পরিশোধের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে করে ব্যাংকগুলো লাভবান হয়েছে। এনবিআরও লাভবান হবে। কারণ এখান থেকে বড় একটা ট্যাক্স পাওয়া যাবে। তাই এনবিআরের সহযোগিতাও আমাদের প্রয়োজন।’
শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জে কেবল বাংলাদেশি পণ্য নয়, বিদেশি পণ্যও কেনাবেচা হবে। কৃষকের ধান উত্তোলনের আগেই এখানে কেনাবেচা হবে। এর সফটওয়ার যদি কিনতে যাই, তাহলে প্রায় ১০০ থেকে দেড়শ’ কোটি টাকা লাগবে। আর একটু ভালো সফটওয়্যার কিনতে লাগবে সোয়া চারশ’ কোটি টাকা। আমরা এত বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি, শিগগিরই এগুলো শুরু হলে মার্কেটের আকার অনেক বাড়বে।’
এনবিআরকে উদ্দেশ করে অধ্যাপক শিবলী বলেন, ‘ক্যাপিটাল মার্কেটকে যত সহায়তা দেয়া হবে ট্যাক্স তত বাড়বে। এখানে ভালো কোম্পানি আনা হলে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাবে না।
‘সিসিবিএল চালু হওয়ার পর আমাদের শর্ট সেল চালুর চিন্তা রয়েছে। কেননা শর্ট সেলের জন্য ট্রেডিং ক্যাপাসিটির উন্নয়ন দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মিউচ্যুয়াল ফান্ড রিসেন্ট সিচুয়েশন খুবই ভালো। তারা ডিভিডেন্ডও দিতে শুরু করছে। না দিলে তাদের ডেকে কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে।’
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা যে রোড-শোগুলো করেছি, এটা মূলত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই হচ্ছে। এটার সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। সামনেও কয়েকটি দেশে আমরা রোড-শো করব।
‘মূলত রোড-শোর মাধ্যমে যখন আমরা আমাদের পণ্যগুলো বিদেশে ব্রান্ডিং করি তখন তারা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কেননা রোড-শোতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা আমাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকেন। তাদের উপস্থাপনে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয়, বিদেশিরা আগ্রহী হয়।’
সিএমজেএফ সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনিরুজ্জামান সিএফএ। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন সিএমজেএফ সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ও প্রফেসর ড. খায়রুল হোসেন, সিএমএসএফের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, এনবিআর সদস্য জাহিদ হাসান, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিওসহ অনেকে বক্তব্য দেন।