বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়াতে হলে দেশের ভালো সরকারি, বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। আর তাদের তালিকাভুক্ত করতে হলে দিতে হবে সঠিক প্রণোদনা। পাশাপাশি সহজ ব্যাংক ঋণ বন্ধ করতে হবে। অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যেন কর ফাঁকি না দিতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল শনিবার পুঁজিবাজারবিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়গুলো উঠে আসে।
বক্তারা বলেন, কোনভাবেই দেশের পুঁজিবাজারে আইপিও বন্ধ করা যাবে না, এ ছাড়া দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা উচিত এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে কর কাঠামো ঠিক করা দরকার। আর পুঁজিবাজারকে বড় করতে হলে সহজ ব্যাংক ঋণ বন্ধ করতে হবে।
শনিবার সকালে দেশের পুঁজিবাজার সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) আর মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’।
বাজারে ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান ।
তিনি তার গবেষণায় দেখান, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলোর মুনাফা যে হারে বেড়েছে; পুঁজিবাজারও সেই হারেই বেড়েছে।
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের অনেক বেশি বিলিয়ন ডলার কোম্পানি লাগবে, যে কোম্পানিগুলো রিলায়েবল, যেগুলো অনেক বছর ধরে টেকসইভাবে বাড়তে পারবে।’
এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে, তাদের যদি পুঁজিবাজারে আনা যায় তাহলে দেশের পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়বে, দেশের বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবে, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।’
লাগবে প্রণোদনা, বাড়াতে হবে সুশাসন
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলার ছিল- ঋণ দিতে হলে কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ওপরে দিতে হবে। এই সার্কুলারটা এখনো পুরোপুরি ইফেক্টিভ হয়নি। এটা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে দেখা যাবে কোম্পানিগুলো নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে সঠিক তথ্য দেবে।’
‘এখন কোম্পানিগুলো কর না দিয়েও ছাড় পেয়ে যায় কিন্তু যখন সঠিক তথ্য দিতে হবে তখন কিন্তু কোম্পানিগুলো ট্যাক্স ইনসেনটিভ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে তখন কোম্পানিগুলো করা ছাড় পাওয়ার জন্য দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাইবে।’
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের পার্থক্য কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করতে। কিন্তু বাজেট করার সময় এসব কেন আমলে নেয়া হয় না, আমি বুঝি না।
‘তালিকাভুক্ত হলে যদি ১৫ শতাংশ কম কর দিতে হয় তাহলে অনেক কোম্পানি দেশের পুঁজিবাজারে আসবে বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি ভালো কোম্পানিগুলো না আসতে চাইলে দরকার হলে আইন করে ভালো কোম্পানি যেমন নেসলে বা ইউনিলিভার-এর মতো কোম্পানিগুলোকে দেশের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা উচিত।’
এ প্রসঙ্গে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন ‘আমাদের দেশে একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে অনেক কমপ্লায়েন্সের মধ্যে থাকতে হয়। অন্যদিকে নন লিস্টেড কোম্পানিগুলো অনেক ধরনের কমপ্লায়েন্স এড়িয়ে যেতে পারে।’
আইপিও বন্ধ করা যাবে না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল বৈঠকে মত দেন, দেশে যেহেতু শেয়ারের পর্যাপ্ত চাহিদা নেই, তাই আপতত আইপিও বন্ধ করা দরকার। বৈঠকে কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশে আইপিওর মাধ্যমে টাকা তোলা ৫০ শতাংশ কোম্পানি খারাপ করছে।
কিন্তু আইপিও বন্ধ না করার পক্ষে মত দেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ।
ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘আমাদের সাপ্লাই এবং ডিমান্ড দুটোই বাড়াতে হবে কোন ভাবেই আইপিও বন্ধ করা যাবে না।’
এছাড়া আইপিওর মাধ্যমে টাকা তোলা কোম্পানি গুলোর খারাপ করারা বিষয়ে সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান এম খাইরুল হোসেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আমাদের দেশে তুলনায় বেশি কোম্পানি খারাপ করছে ভারতে ৪০ শাতংশের বেশি কোম্পানি নন পারফরমিং।
মিউচুয়ার ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা উচিৎ
আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সাধারন বিনিয়োগকারীরা যদি দেশের মিউচুয়াল ফান্ড এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের ডিসক্রিশনারি একাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন তাহলে কম ক্ষতির মুখে পড়বেন দেশের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে। ’
পুঁজিবাজারে কর কাঠামো ঠিক করা দরকার
বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘উন্নত দেশ গুলোর তুলনায় আমাদেরতো ডিভিডেন্ড ইল্ড অনেক হাই।ইন্ডিয়ার তুলনায় আমাদের ডাবল ডিভিডেন্ড ইল্ড। ইন্ডিয়াতে ডিভিডেন্ড ইল্ড ২ শতাংশের ঘরে আমাদের দেশে ডিভিডেন্ড ইল্ড চর শতাংশের উপরে। লভ্যাংশ ভাল থাকলেও আমাদের দেশে লভ্যাংশের উপরে বেশি কর দিতে হচ্ছে তাই আনেকে এখানে বনিয়োগ করতে চাননা।’
সহজ ব্যাংক ঋণ বন্ধ করতে
গোল টেবিল বৈঠকে পুঁজিবাজার বড় এবং ভালো করতে সহজ ব্যাংক ঋণ বন্ধ করার পরামর্শ দেন অনেকেই। এ বিষয়ে বিএমবিএ’র সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা ব্যবসা করে তারা খুব সহজেই ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে যায়। আমাদের এই বিষয়টি বন্ধ করতে হবে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের স্টাক মার্কেট সঠিকভাবে ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না। আমাদের ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে না। নতুন নতুন কোম্পানিগুলো আসার মতো সুযোগও তৈরি হচ্ছে না। যেখানে ভালো কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিতে ব্যাংক মুখিয়ে আছে, সেখানে তারা ক্যাপিটাল মার্কেটে ভালো সুযোগ না পেলে তারা কেন আসবে? সুতরাং যতদিন ব্যাংকের লং টার্ম লোন দেয়ার তারল্য থাকবে, ততদিন ভালো কোম্পানি এখানে আসতে আগ্রহ দেখাবে না।’
সবার বক্তব্য শেষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘আমরা ক্রিটিসাইজ করব, আমাদের ভালোর জন্য। তার আগে আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, আমাদের তুলনা কার সাথে হচ্ছে, এবং আমাদের বাস্তবতা কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম, যখন মাঠে এসেছি, দেখছি বইয়ে লেখা নিয়মকানুন সব জায়গায় পালন করা যায় না। বুকসের অ্যাপ্লিকেশন অনেক সময় করা যায় না, এবং বাস্তবতার নিরিখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি অনেক কিছুই চাই করতে। কিন্তু পারব না এই মূহুর্তে বা দুই বছরের মধ্যে। অনেক কিছুই প্রস্তুত না।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম
তিনি বলেন,‘ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি যদি না থাকে, কাজ করা না যায়, ডেরিভেটিভস মার্কেট নিয়ে কতটুকু এগুতে পারব। কয়টা লোক এর মানে বোঝে? এই জিনিসটা যে কী, কী করতে হবে, বাংলাদেশের পয়েন্ট ০১ শতাংশ মানুষও কি সেটা জানে। তাহলে কীভাবে ডেরিভেটিস মার্কেট নিয়ে কাজ করব?
‘আমি যেখানেই কাজ করতে যাই, ডিজিটাল বোর্ড নিয়ে, আইটিতে লোক পাই না। আমি যদি অপশনাল ডেরিভেটিস নিয়ে কাজ করছি, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নিয়ে কাজ করছি চিটাগংয়ে, আরইআইটি নিয়ে কাজ করছি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে, কই লোক তো পাচ্ছি না। কে করবে এগুলো। যদি কাজ করারই লোক না থাকে এই মার্কেটে প্লে করবে কারা? তাই লিটারেসি নিয়ে আমাদের প্রথম কাজ করতে হচ্ছে।’
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলের চেয়ারম্যান ও সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মোঃ জাহিদ হাসান, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ইউনূসুর রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সিএমজেএফ সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিএমজেএফ সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।