পাশের দেশ ভারতে পোশাক রপ্তানিতে আশা জাগানিয়া সাফল্য অর্জন করে চলেছে বাংলাদেশ; কিন্তু চীনে বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতে প্রায় ১৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
এই অঙ্ক গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বা ৯৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই দুই মাসে দেশটিতে ৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতে ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৮ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। বেড়েছে ৯৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
তবে বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ চীনে পোশাক রপ্তানির তথ্য হতাশাজনক। এই দুই মাসে চীনে মাত্র ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে চীনে পোশাক রপ্তানি থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
ভারতে পোশাক রপ্তানির এই উল্লম্ফন আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে- এমন আশার কথা শুনিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হতে চলেছে ভারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হোঁচট খেলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। বছর শেষে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে তাতে ভারতে বাংলাদেশের পোশাকসহ অন্য সব পণ্য রপ্তানি বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
গত দুই অর্থবছরে সব দেশেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেশ বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছিল ৭২ কোটি ডলার (ওভেন ৪০ কোটি ও নিট ৩১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার)।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি থেকে ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ২০ হাজার ডলার, প্লাস্টিকদ্রব্য থেকে ৩ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে ৪ কোটি ডলারের মতো আয় হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র তিনটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত তিন বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন, যা ছিল এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে এ আয় বেশি ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির এক প্রতিবেদনে ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল, দুই বছরের মধ্যে ৩০০টি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ভারতে বিক্রয়কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করছে। কারণ, দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ১৯ শতাংশ হারে বাড়বে, যা কিনা চীন, ব্রাজিল ও মেক্সিকোর তুলনায় দ্রুত। ২০২২ সালে ভারতের কাপড়ের বাজার হবে ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।’
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা করছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে। ফলে আমাদের রপ্তানি কমবে।’
‘প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে বেশ আলো আলোচনা হয়েছে। ‘সেপা’র বিষয়েও দ্রুত ভালো সিদ্ধান্ত আসবে বলে মনে হচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, ভারতে আমাদের রপ্তানি দিন দিন বাড়বেই বলে মনে হচ্ছে।’
একই কথা বলেছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও ভারতে রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা অর্থবছর শুরু করেছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় আমরা পোশাক রপ্তানিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। ওই দেশগুলোর মানুষ এখন পোশাক কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় আমরা যদি ভারতে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়।’
দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার পারভেজ বলেন, ‘ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এখন থেকে তা বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। প্রায় দেড়শ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার থেকে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি পোশাক কিনছে।’
‘ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এখন বাংলাদেশের কারখানায় পোশাক তৈরি করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। এতে তাদের একদিকে যেমন লিড টাইম কম লাগছে, অন্যদিকে খরচও কম হচ্ছে।‘
সব মিলিয়ে ভারতের বিশাল বাজার বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য আগামী দিনে ‘সুদিন’ বয়ে আনবে বলে মনে করছেন পারভেজ।
‘ভারতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্র্যান্ড-সচেতনতা। এ কারণে সেখানে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোও শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। আবার আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও দেশটিতে নতুন নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খুলতে শুরু করেছে। সেই সুফলই এখন পাচ্ছে বাংলাদেশ।
`এটা অব্যাহত রাখতে হবে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বিজেপি ও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে। এটাই উপযুক্ত সময়। সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে ভারতের বাজার ধরতে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাদেশের নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ভারতের দুইজন বায়ার আমার কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারা দুইজন আমার পুরোনো ক্রেতা। এবার তারা এসেছেন আরও বেশি অর্ডার দিতে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ভারতে আমাদের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। আমরা বেশ ভালোভাবেই ভারতের বাজারে প্রবেশ করছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ভারতে আমাদের রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। এটা বাড়ছেই। সত্যি কথা বলতে কি, ভারতের বাজার যদি আমরা মোটামুটি ভালোভাবে ধরতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে না। কেননা, ভারত আমাদের পাশের দেশ, পরিবহন খরচ খুবই কম পড়বে। আমাদের মুনাফা বেশি হবে।’
‘ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যদি কখনো কোনো কারণে সমস্যা হয়, তাহলেও আমাদের সমস্যা হবে না।’
অন্যান্য দেশেও ভালো প্রবৃদ্ধি
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে (ইইউ) বাংলাদেশ ৩৪৪ কোটি (৩.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। এই দুই মাসে জার্মানিতে রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়াও স্পেন এবং ফ্রান্সে রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৫২ ও ৩৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
জুলাই-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ। যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৬৪ ও ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এই দুই মাসে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৮ শতাংশের মতো। এর মধ্যে জাপানে বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। তবে রাশিয়া ও চীনে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ।