সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএল নামে যে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণের কাজটি করে থাকে, সেটির তথ্য কি নিরাপদ?
পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা পুঁজিবাজার-সম্পৃক্তরা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, সিডিবিএলে যারা কাজ করেন, তারা বা তাদের স্বজন বা নির্ভরশীলরা যেন কোনোভাবেই শেয়ার কেনাবেচার তথ্য না পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
এটা কি সম্ভব? বা এই তথ্য জেনে নিয়ে সিডিবিএলের কর্মীরা কি কোনো শেয়ার কিনছেন- নানা জনের নানা মত। তবে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে কোথাও যে একটি ফাঁক রয়ে গেছে, সেটি পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের বক্তব্যেই স্পষ্ট।
যে বিতর্ক তুলেছেন কাজী ফিরোজ রশীদ
সম্প্রতি সিডিবিএল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংসদ সদস্য ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ট্রেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠান কাজী ফিরোজ রশীদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ।
গত ৩০ আগস্ট তিনি বলেন, ‘যারা কোম্পানির শেয়ার নিজেরাই কেনাবেচা করে, তাদের কাছে যদি শেয়ার রাখা হয় (সিডিবিএল বুঝিয়েছেন), অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? শেয়ালের কাছে মুরগি যদি ধার দেন, অবস্থা তাই হয়েছে।
‘আমার কাছে কোন কোম্পানির কত শেয়ার আছে, অন্য লোক যদি জানেন তাহলে তিনি কালকে পজিশন নেবেন শেয়ারবাজারে, কোনটা কিনবেন, কোনটা বেচবেন। এ কারণে শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন হচ্ছে।
‘সিডিবিএলে কারা আছে? তাদের শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে কেনাবেচা হয়। এটা কোনো দেশে হতে পারে না, এটা অনৈতিক। সিডিবিএল বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে থাকা উচিত, তা না, যারা শেয়ার মার্কেটের বড় প্লেয়ার তাদের হাতেই দেয়া আছে।
এ বিষয়ে জানতে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ধরুন, আপনি সিডিবিএলের একজন ডিরেক্টর, আপনার পাঁচটা কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। আবার আপনি জানেন কোন কোম্পানির কত শেয়ার হোল্ডিং রয়েছে কার? তাহলে মার্কেটে অবস্থান নেয়া সহজ হয়ে গেল না?’
প্রত্যক্ষভাবে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদে আমি যা বলেছি, সেটাই আমার বক্তব্য।’
ফিরোজ রশীদের উদ্বেগ কি অমূলক
কাজী ফিরোজ রশীদ যে উদ্বেগের কথা বলছেন, সেটি যে একেবারে অমূলক নয়, সেটি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিওর বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিডিবিএল শেয়ার ব্যবসায় জড়িত বিষয়টি এমন নয়। তবে সিডিবিএল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হয়তো অনেকেই মার্কেটে পজিশন নিয়ে থাকতে পারেন।’
তবে এসব ঘটনা অতীতে ঘটেছে- এখন ঘটছে না, এমন দাবি করলেন তিনি। বলেন, ‘অতীতে অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও এখন এসব নেই বললেই চলে। সিডিবিএল এখন অনেক সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘সিডিবিএল একটা প্রতিষ্ঠান, সেটা তো আর ব্যবসা করে না। উনি কোনো পরিচালকের কথা বোঝাতে চেয়েছেন হয়তো। তার পরও সিডিবিএল থেকে সরাসরি এসব তথ্য নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ নেই।’
কাজী ফিরোজ রশীদের দাবি অনুযায়ী সিডিবিএলকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে রাখার কোনো যৌক্তিকতাও নেই বলে মনে করেন তিনি।
শাকিল রিজভী বলেন, ‘কোনো দেশের সিডিবিএলের মতো প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থাকে না। এটা একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান। তবে এর পরিচালনা পর্ষদে কারা থাকবেন সেটা নিয়ে আলোচনা থাকলে হতে পারে, কিন্তু কাঠামোগতভাবে সিডিবিএল একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান। এটা ঠিকই আছে।’
বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘তিনি যেটা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, সিডিবিএলে যে তথ্য রয়েছে তা আসলে ঝুঁকিতে রয়েছে। সিডিবিএলের স্টাফ বরাবরই করাপ্ট। ডিএসই, বিএসইসি থেকে যে ডেটা বের হয় সেটা কারেন্ট ডেটা, আর সিডিবিএল থেকে যেটা বের হয় তা হলো- কার কী হোল্ডিংস আছে সেটা। এতে করে বাজারের বড় প্লেয়াররা টাকা দিয়ে শেয়ার কিনে পজিশন নিয়ে নেয়।
‘তবে সিডিবিএলের পরিচালকরা শেয়ার ব্যবসা করেন, এই কথা পুরোপুরি ঠিক না। এমন কোনো লোক সেখানে নেই। এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। উনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, সিডিবিএলের ডেটা বের হয়ে যায়, সেটা নিয়ে অন্যরা ব্যবসা করেন। তবে সিডিবিএলের পরিচালকরা ওইখান থেকে ডেটা নিয়ে ব্যবসা করেন এটা ঠিক না।’
এ বিষয়ে কথা বলতে গত বুধবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় সিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শুভ্র কান্তি চৌধুরীর সঙ্গে। সে সময় তিনি দেশের বাইরে আছেন, কথা বলা সম্ভব নয় বলে জানান।
রোববার ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সিডিবিএল কী করে
২০০০ সালের ২০ আগস্ট ১৯৯৪ কোম্পানি আইনে পাবলিক লিমিটেড হিসাবে ব্যবসা শুরু করে সিডিবিএল। শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তন হয়, সেটা তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করাই সিডিবিএলের প্রধান কাজ।
ধরা যাক, কেউ গ্রামীণফোনের ৫০০টি শেয়ার কিনবেন, এবং যখনই তিনি ৫০০টি শেয়ারের জন্য টাকা পরিশোধ করবেন, সঙ্গে সঙ্গে ওই ৫০০টি শেয়ারের মালিক হবেন তিনি।
যখন কোনো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করা হয় তা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে সিডিবিএল জানিয়ে দেয়। কারও শেয়ার কেউ যেন নিয়ে যেতে না পারে না বা হারিয়ে না যায় তার দেখাশোনা করা এই সিডিবিএলের কাজ। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীর শেয়ারের নিরাপদ রাখাই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ।
সিডিবিএল সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক সিস্টেমে কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদির হিসাব দেখভাল করে। যার ফলে শেয়ার সার্টিফিকেট চুরি হওয়া, পুড়ে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা, লুটপাট হওয়ার মতো আশঙ্কা থেকে মুক্ত।
পেশাদার একজন সিইও এর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। স্টক এক্সচেঞ্জ, কয়েকটি ব্যাংক, আইসিবি, কিছু বড় কোম্পানি সিডিবিএলের মালিকানায় রয়েছে। প্রতি বছর তারা একটি চার্জ নিয়ে থাকে, যেটাকে বলা হয় বিও মেইনটেন্যান্স ফি।