বৈশ্বিক সংকটকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অস্থির করা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। কারসাজিতে জড়িত অসৎ ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় হচ্ছে জরিমানা। তাতেও এই অপতৎপরতা থামছে না। এ অবস্থায় বেঁধে দেয়া হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৯ পণ্যের দাম। কিন্তু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর অসহযোগিতায় এই উদ্যোগ সেভাবে গতি পাচ্ছে না।
পণ্য ধরে ধরে তথ্য চেয়ে আমদানিকারক ও উৎপাদকদের চিঠি দিচ্ছে ট্যারিফ কমিশন। ইতোমধ্যে মসুর ডাল, আটা-ময়দা, রড ও সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য পাঠাতে তিনদিনের সময় বেঁধে দেয়া হলেও তাতে সেভাবে সাড়া মিলছে না। আটা-ময়দা, মসুর ডাল ও সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তথ্য দেয়া হলেও তা আংশিক।
ট্যারিফ কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পর্যায়ক্রমে ৯টি পণ্য-সংশ্লিষ্টদের কাছেই চিঠি যাবে। এ পর্যন্ত চার খাতের ব্যবসায়ীদের চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের সবার কাছ থেকে তথ্য আসেনি। তথ্য-উপাত্ত পেলে তা বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশন তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে। সেসব তথ্য পাওয়ার পর আমদানির ক্ষেত্রে কাঁচামালের দাম কতটা বেড়েছে তা বিশ্লেষণ করে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এরপর আমাদের কাজ হবে বাজারে তার প্রভাব কতটা পড়ছে তা দেখা।’
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, ‘মূল্য বেঁধে দেয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে টেকসই কোনো উপায় নয়। এক্ষেত্রে বাজারে তদারকি ব্যবস্থাও চালিয়ে যেতে হবে।‘খোলা বাজারে স্বল্প দামে পণ্য বিক্রি করলে বাজারে চাপ কমে আসবে। এক্ষেত্রে চাহিদা কমে গেলে পণ্যমূল্যও কিছুটা কমতে বাধ্য।’
মসুর ডালের তথ্য চেয়ে চিঠি
জুলাই ও আগস্ট মাসে টন প্রতি মসুর ডালের আমদানি ব্যয়ের তথ্য চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন। তিন দিন সময় দিয়ে ওই চিঠিতে দুই মাসের মসুর ডাল আমদানি সংক্রান্ত এক্স বন্ড কপি চাওয়া হয়েছে। আগস্টে ডাল আমদানির ঋণপত্র খোলা সংক্রান্ত ব্যাংক কপিও চেয়েছে কমিশন।
চিঠিতে প্রতিবছরে টন প্রতি উৎপাদন ব্যয় বিবরণী ছাড়াও খোলা ডাল উৎপাদন-পরবর্তী সাপ্লাই চেইনে দেয়া মুনাফা ও এ সংক্রান্ত প্রমাণক এবং প্রতিটন ও কেজি প্যাকেজিং খরচের পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়েছে। প্যাকেটজাত মসুর ডালের সাপ্লাই চেইনে দেয়া মুনাফা ও এ সংক্রান্ত প্রমাণক বা ইনভয়েস এবং উৎপাদন মিলিং পদ্ধতির ফ্লো চার্ট দিতে বলা হয়েছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে আংশিক তথ্য মিলেছে।
পৃথকভাবে উৎপাদক ছাড়াও ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
আটা-ময়দার দাম জানতে চেয়ে চিঠি
অত্যাবশকীয় পণ্য বিপণন আইন, ১৯৫৬ এর ৩ ধারা ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সংশোধন আইন, ২০২০ এর ৭(২) (গ) ধারা অনুযায়ী আটা ও ময়দার উৎপাদকদের কাছে তথ্য চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো চিঠিতে গেল দু’মাসের আমদানি ব্যয়, আমদানি সংক্রান্ত এক্সবন্ড কপি, ঋণপত্র সংক্রান্ত তথ্য ও উৎপাদন ব্যয় বিবরণী চাওয়া হয়েছে। এছাড়া বাই প্রোডাক্ট হিসেবে প্রাপ্ত পণ্য যেমন ভূষি, সুজি ইত্যাদি থেকে ব্যয় রিকভারির হার, খোলা আটা-ময়দা উৎপাদন পরবর্তী সাপ্লাই চেইনে দেয়া মুনাফা ও এ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র দিতে বলা হয়েছে চিঠিতে।
চিঠিতে প্রতিটন বা কেজি প্যাকেজিং খরচের পরিমাণ, সাপ্লাই চেইনে দেয়া মুনাফা ও এ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র, উৎপাদন পদ্ধতি ফ্লো চার্ট, রপ্তানি সংক্রান্ত ই-এক্সপি’র কপি জমা দিতে বলা হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্টরা যেটুকু তথ্য দিয়েছে তা আংশিক।
পৃথকভাবে উৎপাদক ছাড়াও ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন। তিন দিনের মধ্যে এসব তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
সিমেন্টের তথ্য পাওয়া যায়নি
সিমেন্ট আমদানি ও উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য দিতে সব উৎপাদকের কাছে ৩১ আগস্ট চিঠি পাঠিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। এক্ষেত্রে তিন দিনের সময় বেঁধে দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। তাদের পক্ষ থেকে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। তবে এমএস রড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
তেল-চিনি নিয়ে রোববার বৈঠক
ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য নির্ধারণ করা নিয়ে রোববার বৈঠক ডেকেছে ট্যারিফ কমিশন। বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই দুই পণ্যের বিশ্ববাজার, আমাদানি ব্যয়, উৎপাদন ব্যয়, লভ্যাংশসহ সার্বিক দিক পর্যালোচনা করা হবে।যদিও এই দুই পণ্যের সব তথ্য সংরক্ষণ করেছে ট্যারিফ কমিশন। তাছাড়া আগে থেকেই পণ্য দুটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
চালের দাম বেঁধে দেবে না কমিশনসার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ৯টি পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। পণ্য তালিকায় আছে চালও। তবে চালের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেবে না ট্যারিফ কমিশন।
সূত্র জানায়, এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, ‘সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে পণ্যমূল্যে ভোক্তাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া সম্ভব। কৃষক পর্যায়ে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন বাড়বে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ট্যারিফ কমিশন বৈঠক করে মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করবে। তারপর যাচাই-বাছাই করে নির্ধারণ করা হবে দাম। সে ক্ষেত্রে সময় প্রয়োজন।
৯ পণ্যের এক মাসের বাজার চিত্র
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শনিবার প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৭৫ টাকা। মাঝারি চাল প্রতি কেজি এখন ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে তা ছিল ৫৬ টাকা। মোটা চাল প্রতি কেজি ৫২ টাকা, এক মাস আগেও তা-ই ছিল।
প্যাকেট আটা প্রতি কেজি ৫৮ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৫০ টাকা। খোলা আটা প্রতি কেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে তা ছিল ৪৫ টাকা।
মাসের ব্যবধানে প্যাকেট ময়দার দাম একই রয়েছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। এক কেজি খোলা ময়দা এক মাস আগে ছিল ৬২ টাকা। এখন দুই টাকা কমে হয়েছে ৬০ টাকা।
ভোজ্যতেলের মধ্যে বোতলজাত সয়াবিন এক লিটার ১৯২ টাকা, এক মাস আগে যা ছিল ১৯০ টাকা। খোলা সয়াবিন পাঁচ লিটার বিক্রি হচ্ছে ৯৪৫ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৯০০ টাকা।
মসুর ডাল বড় দানা এক মাস আগের দর প্রতি কেজি ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি দানার মুসর এক কেজি ১২০ টাকা ও ছোট দানা ১৪০ টাকা কেজি। একক মাস আগে তা ছিল ১৩৫ টাকা।
চিনি প্রতি কেজি ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ছিল ৮৫ টাকা। প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। এক মাস আগে তা ছিল ৪৭ টাকা।টিসিবি’র তথ্য বলছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৪০ গ্রেড রড প্রতি টন ৭৯ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিন সপ্তাহ আগে তা ছিল ৭৭ হাজার টাকা। তবে বাজারভেদে দেখা গেছে, বর্তমানে এক টন রড ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।খুচরা পর্যায়ে এখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম কোম্পানিভেদে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও তা ছিল ৪৯০ থেকে ৫০০ টাকা।