দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং চালের বাজারমূল্য স্বাভাবিক রাখতে প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চাল কিনছে সরকার। ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে আসবে এ চাল। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে যে চাল কেনা হচ্ছে তার দাম ভারতের চালের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে সরকারকে গুনতে হবে অতিরিক্ত ১৩৫ কোটি ৯২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য সরকার বলছে, মানের পার্থক্যের কারণে ভারতের চেয়ে ভিয়েতনামে চালের দাম বেশি। সরাসরি থাইল্যান্ড থেকে চাল কিনতে না পেরেই ভিয়েতনাম হয়ে চাল কেনা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ আগস্ট ভিয়েতনামের সরকারি সংস্থা ভিনাফুড ২-এর সঙ্গে চাল কেনার বিষয়ে আলোচনায় বসে সরকার। এতে ৩০ হাজার টন আতপ চালের দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি টন ৪৯৮ ডলার। আর দুই লাখ টন সেদ্ধ চালের দাম ঠিক হয় প্রতি টন ৫২১ ডলার।
এই দুই লাখ টন চাল ভিয়েতনাম নিজ দেশ থেকে সরবরাহ না করে করবে থাইল্যান্ড থেকে।
এর পরের দিন ভারতের নাফিদ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি টন সেদ্ধ চাল বাংলাদেশ সরকারকে ৪৬৫ ডলারে সরবরাহ করার প্রস্তাব দেয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। সিদ্ধান্ত হয় ভিয়েতনামের ভিনাফুড ২-এর কাছ থেকেই চাল সংগ্রহ করা হবে। এতে প্রতি টন চালে অতিরিক্ত ৫৬ ডলার গুনতে হচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। টাকার অঙ্কে এতে সরকারকে গুনতে হবে ১০৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত।
একইভাবে ২৯ আগস্ট মিয়ানমার রাইস ফেডারেশনের সঙ্গে চাল কেনাসংক্রান্ত আলোচনায় বসে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত হয় দেশটি থেকে দুই লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে প্রতি টন ৪৬৫ টাকা দরে। একই চাল সে সময় ভারতের বাজারে মিলছিল প্রতি টন ৪৫০ টাকা দরে। এতে প্রতি টনে সরকারকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে ১৫ ডলার। ফলে ব্যয় বাড়বে ২৯ কোটি ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
সব মিলিয়ে চার লাখ টন চাল কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১৩৫ কোটি ৯২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
থাইল্যান্ড থেকে সরাসরি চাল না কিনে ভিয়েতনামের মাধ্যমে কেন চাল কেনা হচ্ছে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘থাইল্যান্ড থেকে সরাসরি চাল কিনতে আমরা চিঠি দিয়েছি। তারা এতদিনে রেসপন্স করেছে, তাও বলছে কী স্পেসিফিকেশন, রেট কী দেয়া হবে, কে ক্যারি করবে ইত্যাদি। থাইল্যান্ডের সঙ্গে গত বছরেও যখন আমদানির কথা বলেছিলাম, তারা আমাদের না করে দিয়েছিল।
‘আগে কোনো একসময় চুক্তির পরও থাইল্যান্ড থেকে চাল নেয়া হয়নি বলে সেখানে একটি মনোবিরোধ আছে। তার পরও তারা এগিয়ে এসেছে। আমরা এখনও সেখান থেকে নিতে প্রস্তুত আছি এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাড়ে পাঁচ লাখ টনই আমাদের টার্গেট না, আমাদের টার্গেট আরও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামের চালের দাম সব সময়ই বেশি থাকে এর কোয়ালিটির কারণে। গতবার যখন নিয়েছিলাম, তখন বাধ্য হয়ে ৬০৫ ডলার রেটে ৬০০ টন নিয়েছিলাম। এটা ছিল হোয়াইট রাইস। আমরা একটি সোর্সের ওপর নির্ভরশীল থেকে ঝুঁকিতে থাকতে চাই না।
‘থাইল্যান্ড থেকে সরাসরি চাল পেতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি না। তারা যদি তিন মাস পরে রেসপন্স করে যে কী স্পেসিফিকেশন… আমরা যখন লোক লাগিয়ে রেখে সময়মতো রেসপন্স পাই না, তখন দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে তো আমি যেখান থেকে পাব, সেখান থেকে নেব। তখন তো টাকার দিকে দেখে লাভ নেই।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আজকে যদি ৪৪৩ দশমিক ৫ ডলারের ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে থাকি, তারপরের দিন যদি নাফিদের সঙ্গে ৪৬৫ ডলার চুক্তি করি, তাহলে সেখানকার মার্কেটের অবস্থাটা কী হবে? আপনিই প্রশ্ন করবেন। একেক দেশ একেক রকম।
‘আমাদের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। নাফিদের চাল আমাদের ১৫ হাজার টন গতবার ফেরত দিতে হয়েছে, কোয়ালিটির কারণে।’
সরকার কত টাকায় কী পরিমাণ চাল কিনছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চাল আমরা ভিয়েতনাম থেকে কিনছি দুই লাখ টন, নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল থাই অরিজিন। এটা কেনা হচ্ছে ৫২১ ডলারে। আর হোয়াইট রাইস ৪৯৪ ডলারে। ভারত থেকে একটা (চুক্তি) করেছি, সেটা হলো এক লাখ টন, সেটা হলো ৪৪৩ দশমিক ৫ ডলারে। মিয়ানমার থেকে একটা করেছি আমরা, ৪৬৫ ডলারে।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘থাইল্যান্ড রেসপন্স করছে; কিন্তু তারা বলছে, প্রথম নেগোসিয়েশনের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর তারা চাল দিতে পারবে। কিন্তু আমাদের টার্গেট তো হলো সামনের অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর। এখন নেগোসিয়েশনের ছয় মাস পরে যদি চাল দিতে পারে, তাহলে আমরা সেই চাল নিয়ে কী করব।
‘যেটা বলছেন, ভিয়েতনামের চেয়ে ভারতে চালের দাম কম। ভারত থেকে চাল পেলে আমরা খুশি। এতে দাম ও সময় কম লাগে। কিন্তু তারা গম ব্যান্ড করে রেখেছে। এটা পরস্পর রিলেটেড। গমের অভিজ্ঞতা চালে লাগাতে হবে, চালের অভিজ্ঞতা গমে কাজে লাগাতে হবে। চাল যেটা আমরা টেন্ডার করেছি, এতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান এত পরিমাণে চাল দিতে চাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘চাল ভিয়েতনাম ও ভারতেরটার মধ্যে কোয়ালিটির অনেক তফাত। মাথায় রাখতে হবে গত বছরের আগের বছর ৬০৫ ডলারে আমরা ভিয়েতনাম থেকে চাল নিয়েছি। এখানে আমরা ৫২১ ডলারে পাচ্ছি।
‘আমি ৪৪৩ ডলারে ভারতের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট করেছি। সেটা সাকসেসফুল হোক। সেটা রেখে যদি ৪৬৫-তে আমি আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে নিই, তাহলে কালকে আপনিই বলবেন কাল নিলেন ৪৪৩, আজ কীভাবে ৪৬৫ হলো। দুটো চালের মধ্যে আলাদা কোয়ালিটি, আলাদা দেশ।’