নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি সুখবর এসেছে। যে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতিতে ওলোটপালট করে দিচ্ছিল, । আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে; নেমে এসেছে ৯০ ডলারের নিচে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ৯০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এ প্রতিবেদন লেখার সময় (বৃহস্পতিবার রাত ১১টা) প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১ দশমিক ৪০ শতাংশ কমে ৮৯ ডলার ২২ সেন্টে নেমে এসেছে। ডব্লিউটিআই ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দাম নেমে এসেছে ৮৩ ডলার ৭২ সেন্টে; কমেছে ২ দশমিক ১২ শতাংশ।
এই দর গত ৭ মার্চের পর সবচেয়ে কম।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
এছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের বড় বড় শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা কমায় জ্বালানি তেলের দাম কমেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলত দুটি কারণে তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। উন্নত দেশগুলোতে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই তেলের চাহিদা কমছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর।
ডলার প্রাইস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের দর বাড়লে আমদানি মূল্য বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। সে জন্য ডলারের দর বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে, বাংলাদেশও যা করেছে। ডলার বাঁচাতে দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করা হবে।
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। গত ৫ আগস্ট রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।
সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কাছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে পাঁচ টাকা কমানো হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে দাম কমছে, তাতে শিগগিরই দেশের বাজারেও দাম কমবে।
মন্দাভাবের কারণে বিশ্ববাজারে দাম কমার ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, দাম কমতে থাকলে ওপেক তেল উত্তোলন আরও হ্রাস করবে। এতে দাম খুব একটা না-ও কমতে পারে।
বুধবার ওপেক ও সহযোগী সদস্যদেশগুলো ঘোষণা দিয়েছে, তেলের দাম হ্রাস ঠেকাতে তারা উৎপাদন আরও হ্রাস করবে।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল।
গত মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এর পর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে'তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।