কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি তেল এবং ডলার-দিরহামের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, পারফিউম, বিভিন্ন ক্রিম ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পরও তাদের দাবি, পোষাচ্ছে না।
এত বেশি হারে দাম বাড়ার যুক্তি কী, তা জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কোম্পানিগুলোকে ডেকে যে আলোচনা করেছে, তাতে এই দাবি করা হয়। এর মধ্যে বহুল পরিচিত একটি দেশি কোম্পানি বলেছে, তারা দাম বাড়িয়েছেন, ভোক্তাদের না পোষালে তারা কিনবে না।
বুধবার অধিদপ্তর কার্যালয়ে এই মতবিনিময়ে ইউনিলিভার কনজ্যুমার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কল্লোল গ্রুপ অফ কোম্পানিজ, এসিআই লিমিটেডের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
শুরুতেই সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এসব কোম্পানির প্রতিনিধিদের বলেন, ‘তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং নিয়ন্ত্রণ করেও। তবে প্রসাধনী পণ্যগুলোর দাম হিমালয়ের মতো আকাশের দিকে উঠেছে। ডলার বলেন, কাঁচামাল বলেন, এগুলো কমলে আর কমাচ্ছেন না, আবার বাড়লে সেখান থেকে বাড়াচ্ছেন।’
কাঁচামালের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য বাড়লেও কাঁচামালের দাম কমলে কেন পণ্যমূল্য কমে না- এমন প্রশ্নও ছুড়ে দেন তিনি।
জবাবে প্রসাধনী কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলেন, তাদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামালের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এগুলোর দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ডলার ও দিরহামের বিপরীতে টাকার দরপতনেও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
আগের তুলনায় খরচ ৯৬ শতাংশ বেড়েছে দাবি করে প্রতিনিধিরা বলেন, তারা ভোক্তাদের স্বার্থের কথা ভেবে দাম কম বাড়িয়েছেন। এ কারণে তাদের লোকসান হচ্ছে।
ইউনিলিভারের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) জাহিদ মালিতা বলেন, ‘ভোক্তা ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) নিশ্চিত করলে ব্যবসা ভালো হবে। ইউনিলিভার আধা সরকারি কোম্পানি। সরকারের শেয়ার আছে ইউনিলিভারে। গত দুই বছরে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে এটা কি কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে নাকি কস্ট বেইজ তা আপনারা যাচাই করে দেখবেন।’
কাঁচামালের ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল মার্কেটে ইনফ্লেশন হলে আমাদের ওপরও এটার প্রভাব পড়ে। এ হিসেবে সব মিলিয়ে একটা পণ্যের দাম বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। কিন্তু আমরা সে অনুসারে দাম বাড়াইনি। সে হিসেবে কিন্তু আমরা লোকসানেই আছি৷’
গত এক বছরে মান ও প্রকারভেদে সাবান-শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। ৮০ টাকা থেকে ডাভ সাবান এখন ১৫০ টাকা। ২০০ গ্রাম ওজনের ইমপেরিয়াল লেদার সাবান (থাইল্যান্ড) ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯৫ টাকা। মানভেদে ৮০ টাকার গায়ে মাখা সাবান বেড়ে হয়েছে ১৩০-১৫০ টাকা।
বডি স্প্রের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ৪০০ মিলির যে নিভিয়া লোশনের দাম ছিল ৬২০ টাকা, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ টাকা। ৩২০ মিলির সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। আগে যেটা বিক্রি হতো ৩৬০ টাকায়, তা এখন বেড়ে হয়েছে ৪৬০ টাকা।
২০০ মিলির জিলেট শেভিং জেল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২৫ টাকা। দাম বেড়েছে গুঁড়া সাবানেরও। এক কেজি ওজনের গুঁড়া সাবান এখন ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮০ টাকা।
মানভেদে ২০০ গ্রাম ওজনের সব ব্র্যান্ডের টুথপেস্টে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। যেমন- ২০০ গ্রাম ওজনের কোলগেট টুথপেস্টের দাম ১৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।
তবে ইউনিলিভার কর্মকর্তা জাহিদ বলেন, ‘যে পরিমাণ ইনফ্লেশন হয়েছে সে অনুযায়ী আমরা দাম বাড়াই নাই। টুথপেস্টের দাম সে অনুযায়ী বাড়েনি। গত দুই বছরে মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে তা। ওয়াশিং পাউডার আর সাবানের দাম বেড়েছে।’
স্কয়ার টয়লেট্রিজের হেড অব অপারেশনস মালিক সায়িদ বলেন, ‘সবকিছুই দাম হুট করে বেড়ে যায়নি। দাম বেড়েছে ধীরে ধীরে। ৫০, ৬০, ৭০ থেকে ১০০ পর্যন্ত এভাবে দাম বেড়েছে। ভোক্তারা বিরক্ত হলে তারা অন্য ক্যাটাগরিতে চলে যাবে। রিস্ক নিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আর এতে বিক্রির পরিমাণ কমছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি দাম (কাঁচামালের) কমার চিত্র দেখি, তাহলে আমরা দাম কমাব।’
ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভোক্তারা আপনাদের রঙিন বিজ্ঞাপন দেখতে চায় না। আপনারা পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ান, কমার সময় সেভাবে কমে না। এক জায়গায় লক হয়ে থাকে। এরপর হিমালয়ের মতো ওপরের দিকে উঠতেই থাকে।’
ভোক্তা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সংগঠক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ডিটারজেন্টের কাঁচামাল সালফিউরিক অ্যাসিড ও সোডিয়াম সালফেট নামে এনে সোডিয়াম ক্লোরাইড বলে সাদা লবণ হিসেবে মার্কেটিং করছে। যে প্রোডাক্ট বেশি বিক্রি হয় কোম্পানিগুলো সেগুলোর দামই বাড়াচ্ছে। অথচ যেটার দাম বাড়ালে অন্য কোম্পানির দখলে তা চলে যেতে পারে, তার দাম কিন্তু আপনারা বাড়ান না। কিন্তু যেই পণ্যের মনোপলি তৈরি করে ফেলেছেন সেটার দাম বাড়াচ্ছেন।’