দুই দিনের দর সংশোধন শেষে পুঁজিবাজারে সূচক বাড়লেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হঠাৎ করে যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে সেটি স্পষ্ট লেনদেনে।
টানা সাত কর্মদিবস পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে লেনদেন সোমবারই নেমে গিয়েছিল দেড় হাজার কোটির নিচে। সেটি আরও কমল মঙ্গলবার।
১৩ কর্মদিবসের মধ্যে ১২দিন সূচক বেড়ে বিনিয়োগকারীরা যখন গত ১০ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশায়, এমন পরিস্থিতিতে রোববার লেনদেনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত সূচক ৭৮ পয়েন্ট বেড়েও পরে বেলা শেষে ১৮ পয়েন্ট পতন সাধারণ সংশোধন ছিল কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
এই দরপতন শেষে দেশের বাইরে অবস্থান করা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম একটি বার্তা পাঠান যে, পুঁজিবাজারের ফ্লোর প্রাইস এখনই তোলে নেয়া হচ্ছে না। তিনি জানান, এই ফ্লোর প্রাইস নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে, যে গুজবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহেও দরপতন হয়েছিল।
এরপর সোমবার পতন হয় আরও বেশি। এক পর্যায়ে ৬৮ পয়েন্ট পড়ে গিয়েও পরে ৫৮ পতন হয়। সেদিন লেনদেন নেমে আসে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকাতে, যা আগের দিন দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ছিল।
এদিনও বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ পুঁজিবাজারে বার্তা পাঠান যে, ফ্লোর প্রাইস অনির্দিষ্টকালের জন্য দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
অবশ্য ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী মনে করেন, এটি সাধারণ প্রফিট টেকিং। গত ৩১ জুলাই থেকে পুঁজিবাজার ক্রমাগত বাড়ছিল। এক টাকা ৫০০ পয়েন্ট বাড়ার পর বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলে নেবেন-এটাই স্বাভাবিক।
এর মধ্যে বিএসইসিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া একটি চিঠি ভাইরাল হয়। সম্প্রতি ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনাপদ্ধতি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে করার কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগের সুযোগ অনেক বেড়েছে। পুঁজিবাজারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে বন্ডে নিয়োগে উৎসাহ দিয়ে চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, পুঁজিবাজারের নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
গুজব নাকি প্রফিট টেকিং-এ নিয়ে যখন সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত বিনিয়োগকারীরা, সে সময় মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স শুরুতে বেড়ে গিয়েও বেলা ১২টা ৪১ মিনিটে আগের দিনের প্রায় সমান অবস্থানে চলে আসে আর তা দ্রুত নিচের দিকে নামছিল।
টানা তৃতীয় দিন দরপতন হয় কি না, এই শঙ্কার মধ্যে এখান থেকেই শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানো। পরের এক ঘণ্টায় সেখান থেকে ৪৩ পয়েন্ট বেড়ে বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ কিছুটা দূর করে পুঁজিবাজার।
দুই দিনের সংশোধন কাটিয়ে পুঁঁজিবাজারে সূচক বাড়লেও লেনদেন আরও কমে গেছে
শেষ মুহূর্তের সমন্বয় শেষে আগের দিনের তুলনায় সূচক বাড়ে ৩৯ পয়েন্ট, যা গত দুই দিনে কমেছিল ৭৬ পয়েন্ট। এর আগের ২৩ কর্মদিবসে বেড়েছিল ৫২৮ পয়েন্ট।
৩১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া উত্থানের মধ্যে দুই দিনের সংশোধন কিছুই না। তবে পুঁজিবাজারে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণেও এই ‘বিশ্রামও’ যে বিনিয়োগকারীদের মনে চাপ তৈরি করেছে, সেটি স্পষ্ট লেনদেনেই। আগের দিন লেনদেন কমেছিল আট শ কোটি টাকারও বেশি। সেখান থেকে মঙ্গলবার কমে আরও প্রায় ৭০ কোটি টাকার বেশি।
দিন শেষে হাতবদল হয় ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার শেয়ার, যা আগের দিন ছিল এক হাজার ৪০০ কোটি ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বোরবার লেনদেন ছিল ২ হাজার ২৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ২ হাজার টাকা।
সূচক বাড়লেও কমেছে বেশিরভাগ শেয়ারর দর। ১৪৬টির দর হারানোর বিপরীতে বেড়েছে ১২৭টির দর। ৯৪টি হাতবদল হয়েছে আগের দিনের দরে।
আগের দিন বাড়ে কেবল ৩৮টি কোম্পানির দর, বিপরীতে কমে ২৬৩টির। তার আগের দিনের দরে হাতবদল হয় ৬৮টি কোম্পানির শেয়ার।
লেনদেন নিয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত দুই দিন খুব বড় পতন ছিল এমন নয়। বরং যা পড়েছে তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কয়েকদিন উত্থানের পরে প্রফিট টেকিং হয়েছিল। টার্নওভার একদিক থেকে ভালো বলা যায়। কারণ খুব বেশি সেল প্রেসার ছিল না।’
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ১৩ দশমিক ৮১ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মা। শেয়ারটির দর ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ দর বেড়েছে।
ওরিয়ন ফার্মার দর ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট।
লাফার্জ হোলসিম সূচকে যোগ করেছে ৪ দশমিক ৭১ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ২ দশমিক ০৯ শতাংশ।
এর বাইরে বেক্সিমকো ফার্মা, বসুন্ধরা পেপার মিল, বাংলাদেশ সাবেমেরিন ক্যাবল, কোহিনূর কেমিক্যাল, আরএকে সিরামিকস, রেনাটা ও বেক্সিমকো সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৮২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট সূচক কমেছে গ্রামীণফোনের দর পতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৬২ পয়েন্ট কমেছে ইউনাইটেড পাওয়ারের কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ।
আইপিডিসির দর ২ দশমিক ৩২ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ১ দশমিক ৪১ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ডেল্টা লাইফ, পাওয়ার গ্রিড, আইসিবি, আইডিএলসি, ইউনিলিভার, ন্যাশনাল টি ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১৪ দশমিক ৭২ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দর বেড়েছে সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের। শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ৬৮ টাকায়।
বসুন্ধরা পেপার রয়েছে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। কোম্পানির মুনাফা আগের চেয়ে কমলেও বেশ কয়েকদিন থেকে দর বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
মঙ্গলবার শেয়ারের দর ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৭৩ টাকা ১০ পয়সায়।
৯ দশমিক ৯০ শতাংশ দর বেড়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ওরিয়ন ফার্মা। সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১০৬ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৯৬ টাকা ৯০ পয়সা।
দর বৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সি পার্ল, আরএসআরএম স্টিল, বিকন ফার্মা, ওরিয়ন ইনফিউশন, হাক্কানি পাল্প, কৌহিনূর কেমিক্যাল ও বিডি ওয়েলডিং।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল ফিনিক্স ফাইন্যান্স। শেয়ারটির দর ১০ দশমিক ১০ শতাংশ কমে সর্বশেষ ১৬ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়।
ঋণ কেলেঙ্কারি ও লোকসানে ডুবে থাকা ইউনিয়ন ক্যাপিটাল দর পতনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল। শেয়ারটির দর ৭ দশমিক ০১ শতাংশ কমে লেনদেন হয়েছে ১০ টাকা ৬০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৭২৫ টাকা ২০ পয়সায় হাতবদল হয়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড, ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইএল ইসলামিক মিউচ্যুয়াল ফান্ড-১, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ও হা-ওয়েল টেক্সটাইল।