৭৮ পয়েন্ট বেড়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১৮ পয়েন্ট কমে লেনদেন শেষ করার মধ্য দিয়ে নেতিবাচক যে ইঙ্গিত পুঁজিবাজার আগের দিন দিয়েছিল, সোমবার সেটি আরও জোরাল হলো।
সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবসে সূচক পড়ল ৫৮ পয়েন্ট, যদিও এক পর্যায়ে কমে গিয়েছিল ৬৮ পয়েন্ট।
এদিন বেড়েছে কেবল ৩৮টি কোম্পানির দর, বিপরীতে কমেছে ২৬৩টির। আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে ৬৮টি কোম্পানির শেয়ার, যেগুলোর সিংহভাগই ফ্লোর প্রাইসে হাতবদল হয়েছে।
গত ৩১ জুলাই সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পতন। গত ১০ আগস্ট ৭৮ পয়েন্ট সূচকের পতন হয়েছিল অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ায়।
তবে এরপর থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তি ফিরে পাওয়া, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিসহ নানা ইস্যুতে গত ১৪ আগস্ট থেকে পুঁজিবাজার টানা বাড়তে থাকে।
সেদিন থেকে ছয় কর্মদিবসে ১৬৭ পয়েন্ট সূচকের উত্থানের পর ২৪ আগস্ট ৩৫ পয়েন্ট দরপতনের মধ্য দিয়ে একদিন বিশ্রাম নেয় পুঁজিবাজার।
এরপর থেকে শুরু হয় আরেক দৌড়। আবার টানা ছয় দিন বাড়ে সূচক। এই সময়ে যোগ হয় ২২৮ পয়েন্ট।
এর মধ্যে রোববার লেনদেনের শুরুতে যে চিত্র দেখা দেয়, সেটি এক বছর আগে ১২ সেপ্টেম্বর বাজার সংশোধন শুরু হওয়ার দিন দেখা গিয়েছিল। আগের দিন বেলা সোয়া ১১টার দিকে সূচক ৭৮ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল। দিনের সর্বোচ্চ এই অবস্থান থেকে ৯৬ পয়েন্ট কমে লেনদেন শেষ হয় ১৮ পয়েন্ট সূচক হারিয়ে, যদিও এক পর্যায়ে সূচক পড়েছিল ১০৫ পয়েন্ট।
২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এমন একটি চিত্র দেখা গিয়েছিল, যেদিন থেকে পুঁজিবাজার মূলত সংশোধনে যায়। সে সময়ও পুঁজিবাজার ক্রমেই বাড়ছিল। আর লেনদেন শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে সূচক বেড়ে যায় ৭৮ পয়েন্ট। সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ১২৪ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত সূচক কমে ৫৬ পয়েন্ট।
সেদিন সংশোধন শুরু হলেও বড় মূলধনি কিছু কোম্পানির হাত ধরে সূচক বাড়ছিল। তবে অক্টোবরের সেই দিন থেকে তাও কমতে তাকে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভেদ, বছর শেষে বিনিয়োগ সমন্বয়সহ নানা কারণে বাজার যখন চাপে, তখন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর শুরু হয় ধস।
রোববারের লেনদেনের এই বিষয়টি স্বাভাবিক ঠেকছিল না। পরে দেশের বাইরে অবস্থানকারী বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী-রুবাইয়াত উল ইসলাম জানান, তারা জানতে পেরেছেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হচ্ছে, এমন একটি গুজব ছড়িয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেন, এটি উঠে যাচ্ছে না।
তবে এই নিশ্চয়তা দেয়ার পরদিন পতন আরও বড় হলো। লেনদেন শুরু হয়েছিল যদিও ইতিবাচক প্রবণতা নিয়ে, কিন্তু পতন শুরু হতে দেরি হয়নি।
শেয়ারগুলো দর হারানোর পাশাপাশি বড় পতন হয়েছে লেনদেনেও। আগের দিন চলতি বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে লেনদেন হলেও সেটি নেমে এসেছে দেড় হাজার কোটি টাকার নিচে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন এটি।
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এদিনও ফ্লোর প্রাইস চালু রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কমিশন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার কথা ভাবছেও না। অদূর ভবিষ্যতেও ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে। যদি কেউ এ বিষয়ে কথা বলে, তাহলে বুঝতে হবে কেউ গুজব ছড়াচ্ছে। আমি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিচ্ছি, তারা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার কোনো কথা যেন বিশ্বাস না করে।’
ফ্লোর প্রাইস ইস্যু ছাড়াও বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়া এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বিল পরিশোধের পর সেটি ৩৮ বিলিয়নের নিচে নামার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেটিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলতে পারে।
আবার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গুজবে বিশ্বাস করে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এর আগেও দেখা গেছে, সেটিও একটি কারণ হতে পারে।
আজ যতগুলো শেয়ারের দাম বেড়েছে কমেছে তার ছয় গুণের মতো। ৩৮টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২৬৩টির। আর আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ৬৮টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট।
তবে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিম্পলি প্রফিট টেকিং। আর এর সঙ্গে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার গুজবে কিছুটা প্যানিকড হয়েছে। এ ছাড়া তেমন কোনো কারণ নেই বাজার পতনের।’
কোন খাত কেমন
গতকাল চারটি খাতের লেনদেন ২০০ কোটি ছাড়ালেও আজ মাত্র একটি খাতই এই অঙ্ক ছুঁতে পেরেছে। মাত্র ৩৮টি কোম্পানির দরবৃদ্ধিতে পতনের পাল্লাই ভারী ছিল সব খাতে।
২০৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বা ১৪.৯৬ শতাংশ লেনদেনের মধ্য দিয়ে শীর্ষে রয়েছে প্রকৌশল খাত। আগের দিনেও শীর্ষে থাকা খাতটির লেনদেন ছিল ২৮৮ কোটি ১০ লাখ টাকা বা ১৩.৪০ শতাংশ।
গতকাল যেখানে ১৪টি কোম্পানির দর বেড়েছিল আজ সেখান মাত্র ২টির বেড়েছে। বিপরীতে ৩৭টির দর কমে ও ৩টির অপরিবর্তিত দামে লেনদেন হয়েছে।
আগের দিন ২০০ কোটির বেশি লেনদেন করেও চতুর্থ অবস্থানে থাকা বিবিধ খাত আজ ১৯১ কোটি ১০ লাখ বা ১৩.৯০ শতাংশ লেনদেন করেও তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
এ খাতের কোনো কোম্পানির দর বাড়েনি, বরং কমেছে ১০টির। আর আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ৩টি কোম্পানির শেয়ার।
বস্ত্র খাতেও লেনদেন কমার সঙ্গে দরপতন হয়েছে ব্যাপক। ১৬৩ কোটি টাকা লেনদেনের দিনে দাম বেড়েছে মাত্র ৪টি কোম্পানির, বিপরীতে ১৬টির অপরিবর্তিত ও ৩৯টির দাম কমে লেনদেন হয়েছে।
রোববার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতের অবস্থান নেমে এসেছে চারে। ১৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৫টির দরবৃদ্ধি, ২২টির দরপতন ও ৪টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
এই চার খাতেই লেনদেন হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।
আর লেনদেনের পঞ্চম অবস্থানে থাকা জ্বালানি খাতের মাত্র একটি কোম্পানির দরবৃদ্ধি হয়েছে। বিপরীতে ২২টির দর পতন হয়েছে। দিনভর লেনদেন হয়েছে ৮৭ কোটি ১০ লাখ টাকার।
ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা সেবা খাতের কোনো কোম্পানির দর বাড়েনি। তবে লেনদেন হয়েছে ৮১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার।
এই বাইরে খাদ্য, জীবন বিমা, আইটি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে লেনদেন হয়েছে ৫০ থেকে ৮০ কোটির ঘর পর্যন্ত।
দর পতনের দিনে জীবন বিমায় ৭টি, খাদ্য ব্যাংক ও সাধারণ বিমা খাতে ৪টি করে, ভ্রমণ ও অবকাশ খাতে ২টি, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও টেলিযোগাযোগ খাতে একটি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি দেখা গেছে।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ৮ পয়েন্ট সূচক কমেছে বেক্সিমকোর দর পতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৫২ পয়েন্ট কমেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ।
বেক্সিমকো ফার্মার দর ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ২ দশমিক ৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়া আইডিএলসি, পাওয়ার গ্রিড, বসুন্ধরা পেপার, ইস্টার্ন হাউজিং, আইসিবি, গ্রামীণফোন ও ওরিয়ন ফার্মার দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ২৬ দশমিক ৪২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মা। শেয়ারটির দর ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
আইপিডিসির দর ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট।
সি পার্ল সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এর বাইরে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল, কোহিনূর কেমিক্যাল, পূবালী ব্যাংক, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ওরিয়ন ইনফিউশন, কাশেম ইন্ডাস্টিজ ও ম্যারিকো সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৮ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ দর বেড়েছে সি পার্লের। শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৬২ টাকা ৮০ পয়সায়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ৫৭ টাকা ১০ পয়সায়।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স রয়েছে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। শেয়ারের দর ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সায়।
৫ দশমিক ৬৬ দর বেড়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আইপিডিসি। সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ৬৯ টাকায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৬৫ টাকা ৩০ পয়সা।
দর বৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে- কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন, ফাইন ফুডস, ওরিয়ন ইনফিউশন, জেমিনি সি ফুড ও পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল সোনারগাঁও টেক্সটাইল। শেয়ারটির দর ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ কমে সর্বশেষ ৬৫ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়।
ইস্টার্ন হাউজিং দর পতনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল। শেয়ারটির দর ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমে লেনদেন হয়েছে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে আরএসআরএম স্টিল। ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২০ টাকা ৬০ পয়সায় হাতবদল হয়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড, বসুন্ধরা পেপার, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, ন্যাশনাল পলিমার ও ই-জেনারেশন।