স্ট্যাগফ্লেশন বলতে অর্থনীতির এমন একটি মিশ্র পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কম এবং বেকারত্ব বাড়তে থাকে ক্রমাগত।
কোনো দেশে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সে দেশের সরকার পড়ে বেকায়দায়। কারণ মুদ্রাস্ফীতি কমানোর বেশির ভাগ পদক্ষেপ বেকারত্বের হার বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে বেকারত্ব কমানোর জন্য নেয়া পদক্ষেপগুলো মুদ্রাস্ফীতি আরও উসকে দেয়।
এ রকমই এক স্ট্যাগফ্লেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) বাড়ছেই। যখন পেট্রোলিয়ামের দাম এবং প্রাপ্যতার মধ্যে হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তখন পণ্য উৎপাদন এবং পরিষেবায় অর্থনীতির ক্ষমতা কমতে দেখা যায়।
স্ট্যাগফ্লেশন আসলে কী
স্থবিরতা ও মুদ্রাস্ফীতির সংমিশ্রণ বোঝাতে ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ইয়ান ম্যাক্লিওড স্ট্যাগফ্লেশন শব্দটি ব্যবহার করেন। অরগানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) তেলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। মন্দা কাটাতে সে সময় বিভিন্ন সংস্থা সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। যার ফলে বেকারত্ব বাড়ে উচ্চ হারে।
জ্বালানি উৎসে অস্থিতিশীলতার প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হচ্ছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। এ ছাড়া অপ্রত্যাশিত পেট্রোলিয়াম সরবরাহের চাহিদা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও নাড়া দিয়েছে। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম, ঋণের সুদের হার, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি, গ্যাসের দাম এবং কৃষি পণ্য অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
করোনা মহামারির কারণে এ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সরবরাহে ঘাটতির কারণে ইলেকট্রনিকস পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, গাড়ি এমনকি ওষুধসামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। এতে কমে যায় উৎপাদনও। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে আঘাত এসেছে। স্ট্যাগফ্লেশনের কারণে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঘটেছে, মূল্যবৃদ্ধি ইতোমধ্যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে জটিল করে তুলেছে। এতে সবকিছুর দাম বাড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা পৌঁছেছে চরমে।
কীভাবে স্ট্যাগফ্লেশন নিয়ন্ত্রণ করা যায়
স্ট্যাগফ্লেশন কাটানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রয়োজন, যা নিম্নস্তরের মুদ্রাস্ফীতির বিভিন্ন ধাক্কা শোষণ করতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরবরাহ-শৃঙ্খলের বাধাগুলোকে এমনভাবে এড়ানো যেতে পারে, যাকে অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় প্রভাবিত না হয়। মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন কঠোর আর্থিক নীতি।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এ তরঙ্গ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকিতে ফেলে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উন্নতি প্রয়োজন। আর এ জন্য দরকার কঠোর কিছু পদক্ষেপ। যেমন: বাজেট ঘাটতি ন্যূনতম স্তরে কমিয়ে আনা, কর আইনে সংস্কার ইত্যাদি।
একই সঙ্গে দরিদ্র পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, সব ভর্তুকি প্রত্যাহার, আমদানি পরিশোধের জন্য ডলারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং ঋণ পরিশোধ করা এখন সময়ের দাবি।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব সরকারি ঋণের সঙ্গে দ্বিগুণ হয়; কারণ সেখানে অর্থের সরবরাহ কম থাকে। আর এমন অনিশ্চয়তার কারণে সঠিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগুনো যায় না।
মুদ্রাস্ফীতি এড়াতে উৎপাদনশীলতাকে একটি নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত করতে হবে, যেখানে পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে দ্রুত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রচারের সম্ভাবনা থাকে।