ওমুক কোম্পানির শেয়ার কিনুন, হল্টেড হবে- ফেসবুকে এই ধরনের প্রলোভনে পড়ে ঠকেছেন এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম নয়। অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে উচ্চমূল্যে শেয়ার গছিয়ে দিয়ে একটি চক্র আয় করে বিপুল পরিমাণ।
এই বিষয়গুলো যখন এক রকম ওপেন সিক্রেটের মতো চলছে, তখন সামাজিক মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নজর দিয়ে কয়েকজনসহ ‘হল্টেড মিজান’ নামের একজনকে শনাক্ত করেছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
বুধবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তার বিষয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর মিজানের বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আরও বড় হয়েছে। এখন তুমুল আলোচনা কে এই মিজান? কেন তিনি ‘হল্টেড মিজান’ হিসেবে পরিচিত।
তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেল বিচিত্র তথ্য। তবে মিজান তার আসল নাম কি না, সেটি বলতে পারেন না কেউ।
ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের সম্ভাবনা নিয়ে প্রচার চালাতেন মিজান। দর বৃদ্ধি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। প্রচার করা হতো, তিনি যেসব শেয়ার কেনার পরামর্শ দেন, সেগুলোর দাম সর্বোচ্চ সীমায় বেড়ে সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করে বা হল্টেড হয়ে যায়।
ইংরেজিতে লেখা ‘মিজানুর রহমান’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হতো। প্রোফাইল পিকচারে ব্যবহার করা হয়েছে লাল রঙে লেখা ‘হল্টেড’।
এসব কারণেই তার নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘হল্টেড’ বিশেষণ।
এই ‘হল্ট’ আইটেম দেয়ার বিনিময়ে টাকাও নিতেন মিজান। কখনও ১০২০ টাকা, কখনও ২ হাজার ৫৫০ টাকা আবার কখনও ৫ হাজার ১০০ টাকা।
বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে বলা হতো, এই টাকার ১০ শতাংশ করোনাজনিত দুস্থদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
যারা ফাঁদে পড়তেন, তারা এটা বিবেচনা করতেন না যে, যে লোক কোনো শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হবে, কোনোটির দর ৫০ শতাংশ বাড়বে, তিনি কেন এই কয়টি টাকার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়াবেন।
যা জানেন বিনিয়োগকারীরা
বিনিয়োগকারী মাসুম জামান বলেন, ‘ফেসবুকে অনেক সময় দেখেছি, ওই আইডিতে বলা হচ্ছে যে, আগামী সপ্তাহের জন্য আইটেম রেডি আছে, যারা নিতে চান তারা ইনবক্সে যোগাযোগ করুন। আমি কখনও কিনিনি। অনেকের কাছে শুনেছি যে, এই ধরনের আইটেম বিক্রি হয়।’
ফিদুল বিশ্বাস নামের আরেকজন বলেন, ‘এই ধরনের প্রতারকচক্র খুবই ধূর্ত হয়। কোনো কারণে একটা শেয়ারের দাম বেড়ে গেলে সেটাকেই তারা নিজেদের আইটেম বলে প্রচার করে। তারা বিনিয়োগের অর্ধেক লাভের লোভ দেখায়। এসব ফাঁদে পা দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হন। অনেকে কিছু পয়সা কামাই করে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকসান গুনতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘মিজানুর রহমান নামের ওই ব্যক্তির আইটেম বিক্রির কথা জেনেছি। ব্রোকারেজ হাউসে এ রকম আলোচনা অনেক হয়। অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে যারা দীর্ঘদিন বাজারের সঙ্গে আছেন তারা সহজেই এসব ফাঁদে পা দেন না।’
সেই আইডি এখন বন্ধ
বিএসইসি বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর থেকে মিজানের নামের সেই আইডিটি ডি-অ্যাক্টিভেটেড করে দেয়া হয়। তবে সেই আইডির কিছু পোস্টের স্ক্রিনশট পাওয়া যাচ্ছে।
এতে দেখা যায় এক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘বলেছিলাম বাই প্রাইম ফাইন্যান্স; গতকালও হল্ট হয়েছে। এরকম হট ও টানা হল্ট আইটেম পেতে ইনবক্সে যোগাযোগ করুন।’
আরেকটি পোস্টে লেখা রয়েছে, ‘রবিবারের হল্ট আইটেম!! মার্কেট ওকে। একটি টি+২ হট অ্যান্ড হল্ট আইটেম রেডি। এটি টানা হল্টেড হবে ইনশাআল্লাহ। আইটেম পেতে টাইমলাইন দেখুন/ইনবক্স করুন।’
অন্য আরেকটি পোস্টে লেখা, ‘৫০% লাভের পরবর্তী মানি ডবল আইটেম রেডি। আগের আইটেম ইউনিয়ন ক্যাপ ২১ দিনে ৮১% বেড়েছে; টার্গেট ৫০%+ অতিক্রম করেছে। বাই রেট ছিল ৭.৯০ টাকা, বৃহঃবার ১৪.৩০ টাকা উঠেছে। এরকম হট ও টানা হল্ট ৫০% লাভের/মানি ডবল আইটেম পেতে ইনবক্সে মেসেজ দিন।’
আইটেমের বদলে টাকা
আরেকটি পোস্টে লেখা ছিল, ‘গ্রেট অফার: লেটেস্ট টানা হল্টেড হট আইটেম পেতে আইটেমের নিউজ কালেকশন, এনালাইসিস ও বিবিধ ফি বাবদ টি+২/সাপ্তাহিক প্রতি হট আইটেম এর জন্য মাত্র ১,০২০ টাকা; ৫০% লাভের প্রতি আইটেমের জন্য ২৫৫০ টাকা, মানি ডবল প্রতি আইটেমের জন্য ৫১০০ টাকা বিকাশ করুন। ১০% করোনাজনিত দুঃস্থদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।’
প্রলুব্ধ করার জন্য সেই পোস্টে আরও লেখা হয়, ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এক লাখ লাভ করতে ১ হাজার টাকা ব্যয় করার মানসিকতা না থাকলে শেয়ার ব্যবসা করা যাবে না।
এতে লেখা হয়, ‘হট আইটেমের নিউজ নগদ টাকা দিয়ে নিতে হবে।’
মিজানুর ও তার সহযোগীরা ফেসবুকে এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতেন
বিএসইসি কী বলছে
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তিনি (মিজান) বিভিন্ন শেয়ারের দাম কোথায় যাবে, কোনটা বাড়বে, কোনটা হল্টেড হবে, এসব তথ্য প্রচার করতেন। আর এসব তথ্য প্রদান বা আইটেম বিক্রির মাধ্যমে টাকা নিতেন।’
তিনি আসলে কে- এমন প্রশ্নে রেজাউল বলেন, ‘ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর বাইরে গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে। এ বিষয়ে কাজ করছে বুয়েট থেকে পাস করা একজন আইটি এক্সপার্ট এবং একজন সোশ্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট।
‘ওই ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ও ইমেইল আইডি পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া গেছে। যার মধ্যে দুটি সচল। আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
বুধবার বিএসইসির জানায়, মিজানুর ছাড়াও একই চক্রের আশরাফুল ইসলাম, আয়মান নাহিয়ান কল্লোল ও শরীফুল ইসলাম নামে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের শাস্তির আওতায় আনতে গঠন করা হয়েছে ২ সদস্যের কমিটি।
তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন সহকারী পরিচালক কামাল হোসেন ও এইচ এম সালেহ সাদমান। তাদের আগামী ১০ দিনের মধ্যে মিজানুর রহমানসহ সামাজিক মাধ্যমে গুজব রটনাকারীদের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গুজব ছড়িয়ে মিজানুর ও তার সহযোগীরা কী পরিমাণ লাভবান হয়েছেন, সেটাও বের করা হবে।
বিএসইসি পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে গত কয়েক মাস ধরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে দেন দরবার করে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মতভেদ দূর হয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট শেয়ারের ক্রয়মূল্যে হিসাব করতে বিনিয়োগকারীদের এক যুগের দাবি পূরণ হয়েছে।
এসব ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঝিমুনিতে যাওয়া পুঁজিবাজা প্রাণসঞ্চার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলা দেড় হাজার সূচকের মধ্যে এক মাসে ৫২৮ পয়েন্ট এরই মধ্যে ফিরে এসেছে। যে লেনদেন চার শ কোটির ঘরে নেমে এসেছেন, সেটি এখন নিয়মিত হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই।
এই অবস্থায় বিএসইসি এবার গুজব ঠেকাতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে।
গত ১৭ মে ফেসবুকে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মাহবুবুর রহমান নামের একজনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। বিএসইসির সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে তাকে ধরা হয়।
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত করতে ‘সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সেল’ও গঠন করা হয়েছে।
বিএসইসির মার্কেট সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের (এমএসআইডি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধানে এই সেলের কার্যক্রম চলছে।
এ ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির সহায়তাও নিচ্ছে বিএসইসি। তাদের অভিযোগে গুজব রটনাকারী ৩১টি ফেসবুক আইডি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।