বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পেঁয়াজ সংরক্ষণে আশা জাগাচ্ছে ‘কৃষকের এসি’

  •    
  • ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:৪৭

‘প্রতি মণে আগে চার থেকে পাঁচ সের (কেজি) পেঁয়াজ পচে যেত। কিন্তু এভাবে পেঁয়াজ রেখে আমি সাড়ে ৩০০ মণ পেঁয়াজ বের করে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার কেজি পেঁয়াজ পচা পেয়েছি। পেঁয়াজে দাগও হয় নাই। পেঁয়াজের জিল থাকে ভালো। এই কারণে আমরা এর নাম দিয়েছি কৃষকের এসি।’

প্রতি বছর ৩৫-৩৬ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয় ৩৩ লাখ টন। তবে সংরক্ষণের অভাবে এর এক-চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে যায়। চাহিদার ঘাটতি মেটাতে গিয়ে আমদানির দরজা খুলে দিতে হয় সরকারকে। এ কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন স্থানীয় চাষিরা।

পেঁয়াজ নিয়ে এই সংকট মোকাবিলায় আশার আলো দেখাচ্ছে ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’। ইতোমধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের কাছে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে পেঁয়াজের এসিখ্যাত এই প্রযুক্তি। সুফল মেলায় খুশি সংশ্লিষ্টরাও।

কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত উৎপাদন বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ। এর পরও ঘাটতি মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে বছরের পর বছর। চাহিদার বেশি আমদানি হলে প্রভাব পড়ে বাজারে। দাম পড়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক।

তবে ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পেঁয়াজের অপচয় বা নষ্ট হওয়াকে।

জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজই নষ্ট হয়। আর আমদানির কারণে দেশের অর্থ যেমন অপচয় হচ্ছে, তেমনি ভালো দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন চাষিরা।

সাধারণত প্রচলিত পদ্ধতিতে (সনাতন) বাঁশের মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ হলেও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অধিক তাপমাত্রায় ও অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পে পচন ধরে যায়। এ প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবন হলো ‘বায়ুপ্রবাহ যন্ত্রের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংরক্ষণ’ প্রযুক্তি।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমন্বিত পানিসম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়ের পরামর্শক দলের উদ্ভাবিত ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ ব্যবহৃত হচ্ছে ফরিদপুরের বিভিন্ন গ্রামে। একটি মেশিন স্থাপনে খরচ মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

সরেজমিন ফরিদপুরের সালথা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বেশ কিছু পেঁয়াজ চাষিকে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ পদ্ধতিতে করতে দেখা গেছে। একটি ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর মাদুর বা বানা দিয়ে ঢেকে তার মধ্যে এই যন্ত্রটি স্থাপন করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। ১০০ বর্গফুটজুড়ে তৈরি এমন একটি স্থানে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ রাখছেন বছরের ৮-৯ মাসজুড়ে। এতে কৃষকের মাসে ৫০০-৬০০ টাকার বিদ্যুৎ খরচের বাইরে আর কোনো অতিরিক্ত ব্যয় নেই।

চাষিরা বলেন, সাধারণত বাজারে নতুন পেঁয়াজ ওঠার পরই দাম কমতে থাকে। এ জন্য কিছুদিন সংরক্ষণ না করতে পারলে পেঁয়াজ চাষির লাভ মেলে না। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের মাচা বা চাঙে পেঁয়াজ সংরক্ষণে অধিক তাপমাত্রায় ঘেমে যাওয়া, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পে পচন ধরা, রং নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেন তারা।

জেলার কয়েকটি উপজেলায় গিয়ে দেখা গেছে, ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর ছিদ্রযুক্ত মাদুর বা বানা দিয়ে ঢেকে তার মধ্যে সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ও ১৪ ইঞ্চি চওড়া একটি ভার্টিকাল সিলিন্ডার বসানো হয়েছে। এক হর্স পাওয়ারের একটি বৈদ্যুতিক মোটর যুক্ত করে পাখার সাহায্যে ওপর থেকে বাতাস টেনে নিয়ে নামিয়ে নেয়ার পর আটকে থাকা বাতাস পেঁয়াজের মধ্য দিয়ে বের হচ্ছে। ছোট্ট একটি কক্ষে এভাবে বাতাস প্রবাহ করে মজুতের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

‘কৃষকের এসি’

কথা হয় কয়েকজন চাষির সঙ্গে। তারা ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’-এর নাম দিয়েছেন ‘কৃষকের এসি’। এই নাম দেয়ার কারণ, এই মেশিনে দীর্ঘ সময় ধরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখা যায়। পচে কম, পেঁয়াজের গুণগত মানও থাকে ভালো।

ফরিদপুরের সালথার গট্টি ইউনিয়নের লাহরিপাড়া গ্রামের আবজাল হোসাইন বলেন, ‘এই মেশিনে পেঁয়াজ রাখলে বীজ খুব সুন্দর হয়। গজায় কম। ঘাটতিও কম। পেঁয়াজের রং ও গুণগত মান ভালো থাকে। ফলে এই পদ্ধতির প্রতি নির্ভরতার কারণে অন্যরাও ঝুঁকে পড়ছেন এর প্রতি।

‘প্রতি মণে আগে চার থেকে পাঁচ সের (কেজি) পেঁয়াজ পচে যেত। কিন্তু এভাবে পেঁয়াজ রেখে আমি সাড়ে ৩০০ মণ পেঁয়াজ বের করে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার কেজি পেঁয়াজ পচা পেয়েছি। পেঁয়াজে দাগও হয় নাই। পেঁয়াজের জিল থাকে ভালো। এই কারণে আমরা এর নাম দিয়েছি কৃষকের এসি।’

নগরকান্দার বিলনালীয়ার অহিদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে পেঁয়াজ রাখতে পারছি। নিজের প্রয়োজনমতো বিক্রি করছি। এভাবে রেখে এখন ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছি। না হলে এই পেঁয়াজ ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে হতো।’

একই কথা বললেন সদর উপজেলার কৈজুড়ী ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আব্দুর রহিম শেখ। তিনি ৩০০ মণেরও বেশি পেঁয়াজ পেয়েছেন এবার। আগে চাঙে খামাল দিয়ে পেঁয়াজ রাখতেন। বলেন, ‘এভাবে অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হতো। এ বছর এই মেশিন দিয়ে পেঁয়াজ রাখার পর আলহামদুলিল্লাহ পেঁয়াজ আর আগের মতো পচে না। আগের চেয়ে অনেক সুবিধা হয়েছে এই মেশিনে।’

‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ কাজ করে কীভাবে

এই প্রকল্পের ভ্যালু চেইন স্পেশালিস্ট গাজি মো. আব্দুল্লাহ মাহদী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি ভার্টিক্যাল সিলিন্ডারে মোটর সংযুক্ত করে ছোট একটি কক্ষে এই পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়। এই মেশিনের মাধ্যমে নিচে বাতাস টেনে আটকে দেয়া হয়। পরে সেই বাতাস পেঁয়াজের ভেতর দিয়ে বের হতে বাধ্য হয়। এতে পেঁয়াজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং পেঁয়াজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

‘এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ পচে না। কোনো পেঁয়াজ নষ্ট থাকলে সেটি নিজেই শুকিয়ে যায়, পাশের পেঁয়াজকে নষ্ট করে না। সনাতন পদ্ধতিতে পেয়াজ সংরক্ষণ করলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়, আর এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে মাত্র ১০ শতাংশ নষ্ট হয় । এতে চাষিরা লাভবান হন।’

পচন শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব

এয়ার ফ্লো মেশিনের মাধ্যমে পেঁয়াজের পচন শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব বলে মনে করেন ফরিদপুর অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসএমও স্পেশালাইজড ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালে মোহাম্মদ তোফায়েল চৌধুরী।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজ সংরক্ষণের এই প্রযুক্তিটি প্রথম বছরেই অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বছরের আট মাস এভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এর মাধ্যমে সংরক্ষিত পেঁয়াজের ওজন হ্রাস ৩০ শতাংশ এবং পচন প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। ফলে আমরা নিজস্ব উৎপাদন দিয়েই পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে পারব এবং আমদানির বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হবে না।’

ফরিদপুর চেম্বার অফ কর্মাসের প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে এ পণ্যটি আমদানি করতে হতো না। এতে চাষিরা যেমন লাভবান হতেন, তেমনি ফরেন কারেন্সি সেভ হতো। পেঁয়াজ সংরক্ষণে এখন এয়ার ফ্লো মেশিন ব্যবহার চাষিদের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর