গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণ প্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর।
নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে ৩২ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার দিয়েছিল বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরে কম সুদের বিদেশি ঋণ প্রাপ্তিতে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক অর্থবছরে এত বেশি ঋণসহায়তা পায়নি বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বুধবার বিদেশি ঋণ ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ৪৮ কোটি ৮০ লাখ ৪০ হাজার ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৬৩৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
তবে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা আমেরিকান মুদ্রা ডলারের অস্থির বাজারে টাকার দরপতনে এই বিদেশি ঋণ নিয়ে কিছুটা চিন্তিত অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে এই ঋণ পাওয়া গেলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই ঋণ তো আমরা প্রতি ডলার ৮৪/৮৫ টাকা হিসাবে পেয়েছি।
‘এখন ডলারের দর ১১০ টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তব্যাংক রেট কার্যত অচল। চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংক থেকে ১১০ টাকার বেশি দরে ডলার কিনছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতেও নিচ্ছে ১১০ টাকার বেশি। এতে আমাদের ঋণের বোঝা কিন্তু অনেক বেড়ে যাচ্ছে।’
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের তুলনা নাকচ করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দাতারা যে অর্থ ছাড় করেছে, তার মধ্যে ৪৭ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে অনুদান।
সবচেয়ে বেশি ছাড় করেছে জাপান
জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে জাপান, ২০ কোটি ডলার। চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১০ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ভারত দিয়েছে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ২০ হাজার ডলার।
এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি দিয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
প্রতিশ্রুতি কমেছে
ইআরডির তথ্য বলছে, জুলাই মাসে দাতাদের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি বেশ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাইয়ে ৯৫ লাখ ৮০ হাজার ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। এই বছরের জুলাইয়ে তা কমে ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারে নেমে এসেছে।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৭ শতাংশ
জুলাই মাসে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ১৬৮ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার (১.৬৮ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত বছরের জুলাইয়ে সুদ-আসল বাবদ ১৫৭ কোটি ডলার শোধ করা হয়েছিল।
এ হিসাবে এই জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি অর্থ শোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
যে করেই হোক টাকার মান বাড়াতে হবে
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণ বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কম সুদের বিদেশি ঋণসহায়তা বাংলাদেশের উন্নয়নে বরাবরই অবদান রেখে চলেছে। দুই-আড়াই বছরের মহামারির পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। এরপরও এখন পর্যন্ত আমরা মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছি। এই ঋণ আমাদের অর্থনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় রাখতে অবদান রাখছে।’
‘তবে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে; উদ্বেগেরও সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকে ডলারের দাম ১১০ টাকায় উঠে গেছে। গত অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি যে বিদেশি ঋণ আমরা নিয়েছি, সেটা কিন্তু ৮৪, ৮৫ কিংবা ৮৬ টাকায় নিয়েছি। ডলারের দাম যদি এভাবে বেড়েই চলে, তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানি না। সে ক্ষেত্রে এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কত টাকা দরে ডলার কিনে শোধ করতে হবে, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।’
‘তাই যে করেই হোক, যেভাবেই হোক ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা নাহলে কিন্তু আমাদের সামনে বড় বিপদ আছে।’
পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে ডলার। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দর। বুধবার ১০৪ থেকে ১০৬ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে ব্যাংকে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে বিক্রি হয়েছে ১১১ টাকার বেশি দামে। আমদানি কমলেও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কাটছে না ‘
গত বছরের ২৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ১৫ পয়সা। সে সময় বাজার স্বাভাবিক ছিল। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এই রেটে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করত। নগদ ডলার দুই-আড়াই টাকা বেশি দামে বিক্রি করত। খোলাবাজারেও প্রায় একই দামে ডলার কেনাবেচা হতো।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি বাড়তে থাকায় আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। এখনও সেটা অব্যাহত আছে। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে (ব্যাংক রেট) টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ৯৫ টাকা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে। এটাকেই এখন ইন্টারব্যাংক রেট বা ব্যাংক রেট বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে এর চেয়ে ৯ থেকে ১৪ টাকা বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার বিশাল এই পতন দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- জানতে চাইলে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘ডলারের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে প্রতি মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে। বড় ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আমাদের। আমদানি কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমদানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ডরারের দর কমছে না; এরই মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের।’
‘আমি হিসাব করে দেখেছি, আমাদের বিদেশি ঋণের বোঝা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আমাদের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলিয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার।
‘এক বছর আগে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সে হিসাবে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার অঙ্ক ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের রেট ১১০ টাকা দরে যদি আমি হিসাব করি তাহলে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
‘এই সহজ-সরল হিসাব কষেই আমি দেখতে পাচ্ছি, টাকার পতনে এক বছরে আমাদের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।’
‘এ পরিস্থিতিতে এখন আমাদের টাকার মান বাড়াতেই হবে; যে করেই হোক করতেই হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে।’
টাকার মান বাড়াতে বা ডলারের বিপরীতে টাকাকে শক্তিশালী করতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর।