পুঁজিবাজারের টানা উত্থান অব্যাহত রয়েছে। ছয় দিন সূচক বেড়ে এক দিন সংশোধন শেষে আবার টানা চার দিন বাজারে দেখা গেল ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা। সেই সঙ্গে টানা চার কর্মদিবস লেনদেন হলো দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধন, এরপর দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে মতভেদ, বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ নিয়ে নানা নেতিবাচক কথাবার্তা, এর মধ্যে নানা গুজবে টালমাটাল পুঁজিবাজারের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু গত ৩১ জুলাই।
বাজারের চাঙা হয়ে উঠার বিষয়টি দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। যেটির নমুনা আবার দেখা গেল সপ্তাহের তৃতীয় কর্মদিবস মঙ্গলবার।
আগের তিন কর্মদিবস বাড়ার পর এদিন শুরু থেকে সূচক বাড়তে থাকে উঠানামা করতে করতে। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ৩২ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন। আগের দিন বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতনে ৬ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হলেও এদিন দর হারানো কোম্পানির চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানির সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। আর সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইসেও ছিল বিপুল সংখ্যক কোম্পানি।
এ নিয়ে টানা ১১ দিনের মধ্যে ১০ দিনই বাড়ল সূচক। এই কদিনে বেড়েছে মোট ২৮৪ পয়েন্ট।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়াল ৬ হাজার ৪৩২ পয়েন্ট যা গত ৫৩ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ৯ জুন সূচকের অবস্থান ছিল এর চেয়ে বেশি, ৬ হাজার ৪৮০ পয়েন্ট।
দিন শেষে বেড়েছে ১৮৪ টি কোম্পানির, দর হারিয়েছে ১২৩টি আর আগের দিনের দরে লেনদেন হয় ৭৩টি কোম্পানি। লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি ৩০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, যা আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি।
এদিন সবচেয়ে বেশি শেয়ারের দর বেড়েছে আর্থিক খাতে। ওষুধ ও রসায়ন, প্রকৌশল, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক এবং বস্ত্র খাতেও গেছে দারুণ দিন।
তবে উত্থানের লেশ মাত্র নেই ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে। দুটি খাতই ঝিমচ্ছে।
লেনদেনে আবার সবার চেয়ে এগিয়ে বস্ত্র খাত। এক মাসেরও বেশি সময় ধরেই প্রায় প্রতিদিনই সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই খাতটির লেনদেন ছাড়িয়েছে পৌনে চার শ কোটি টাকা।
২০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন এবং বিবিধ খাতে। এক শ কোটি টাকার বেশি শেয়ার হাতবদল হয়েছে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকায় যেমন কোনো একক খাতের প্রাধান্য দেখা যায়নি, তেমনি সবচেয়ে বেশি দরপতনের তালিকাতেও দেখা গেছে নানা খাতের শেয়ার।
যেভাবে পতন, উত্থান তার চেয়ে দ্রুত
গত অর্থবছরের শেষ মাসের মাঝামাঝি থেকে ব্যাপক দরপতন শুরু হয় পুঁজিবাজারে। গত ১৬ জুন পুঁজিবাজারের সূচক ছিল ৬ হাজার ৪২৫ পয়েন্ট। এরপর থেকে এক দুই দিন বাড়লেও টানা কমতে থাকে সূচক। ২৮ কর্মদিবসে ৪৪৫ পয়েন্ট সূচকের পতনে তলানিতে নামে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস। গত ২৮ জুলাই এক পর্যায়ে সূচক ছয় হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে হয় ৫ হাজার ৯৮০।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দরের ঊর্ধ্বগতি, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, দেশে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিসহ অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে এই দরপতন ঘটতে থাকে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মঙ্গলবারের লেনদেনের চিত্র। ছবি: নিউজবাংলা
সে সময় জেঁকে বসা আতঙ্কের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সিদ্ধান্ত নেয় করোনাকালের মতো আবার সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া হবে।
পরদিন থেকে শুরু হয় উত্থান। মাঝে টানা চার দিন এবং পরে এক দিন সংশোধন হলেও বাকি ১৫ দিন সূচকের উত্থানের পাশাপাশি লেনদেনেও ফেরে গতি।
অর্থাৎ ২৮ কর্মদিবসে যতটা দরপতন হয়েছিল, পরের ২০ কর্মদিসে উত্থান হয় তার চেয়ে বেশি।
উত্থান শুরুর সপ্তাহের টানা পাঁচ কর্মদিবসে ৩০৩ পয়েন্ট সূচক বাড়ার মধ্যে আরও একটি সুখবর আসে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনাপদ্ধতি শেয়ারের ক্রয়মূল্যে করতে দীর্ঘদিনের যে দাবি ছিল, তা পূরণ হয়ে যায় ওই সপ্তাহে। বাংলাদেশ ব্যাংক জারি করে সার্কুলারও।
তবে পরের সপ্তাহে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া নিয়ে আবার গুজবের কবলে পড়ে পুঁজিবাজার। ওই সপ্তাহে আবার টানা চার কর্মদিবসে ১৩৭ পয়েন্ট দরপতন নিয়ে তৈরি হয় বিস্ময়।
তবে ১৪ আগস্ট বিএসইসির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয় যে, ফ্লোর প্রাইস উঠে যাচ্ছে না। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরপর টানা ছয় কর্মদিবসে ১৬৭ পয়েন্ট সূচক বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনেও দেখা দেয় ঊর্ধ্বগতি। এর মধ্যে ২৪ আগস্ট এক দিন সূচক কমে ৩৫ পয়েন্ট, নেমে আসে লেনদেনও। তবে সেটি যে টানা বাড়ার পর এক দিনের বিশ্রাম বা সাধারণ দর সংশোধন, সেটি স্পষ্ট হয় পর দিনই।
এরপর দিন সূচক ৭৪ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির পাশাপাশি চলতি ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেনে এটা স্পষ্ট হয় যে, পুঁজিবাজার থেকে দূরে থাকা ব্যক্তি শ্রেণির ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে।
এর পর দিন গত বছরের ১২ অক্টোবরের পর প্রথমবারের মতো দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেনের মধ্যে এক পর্যায়ে সূচক বেড়ে যায় ৮৬ পয়েন্ট, যদিও শেষ পর্যন্ত ৪৬ পয়েন্ট যোগ করে শেষ হয় লেনদেন।
দুই দিনের বড় উত্থান শেষে আবার দর সংশোধন হয় কি না, এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে দর সংশোধন হয় কি না, সেদিকে দৃষ্টি ছিল পরের দিনের লেনদেনে। তবে এক পর্যায়ে সূচক কমেও গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৯ পয়েন্টের উত্থানে পুঁজিবাজারের শক্তির বিষয়টি প্রকাশ চায়।
সূচকের পাশাপাশি লেনদেনের বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মধ্যে এক পর্যায়ে লেনদেন ৪৪১ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল গত ২৮ জুলাই। মঙ্গলবার মিলিয়ে টানা ১০ কর্মদিবস তা হাজার কোটি টাকার বেশি হলো। এর মধ্যে এক দিন ছাড়িয়েছে দুই হাজার কোটির ঘর, তিন দিন দেড় হাজার কোটির বেশি।
মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজার খুব ভালো ট্রেন্ডে আছে। সেটি কয়েকটি বিষয়ে নজর দিলেই পরিষ্কার। প্রায় দুই মাসের কাছাকাছি সময়ে সূচকের অবস্থান সর্বোচ্চ দেখা যাচ্ছে। চার কর্মদিবস দেড় হাজারের বেশি লেনদেন হলো, এর মধ্যে একদিন দুই হাজার কোটি অতিক্রম করেছিল। আর ১০ কর্মদিবস এক হাজার কোটির বেশি লেনদেন হলো। সব মিলিয়ে বাজার একটি ইতিবাচক ধারায় অবস্থান করছে।'
তিনি বলেন, 'অর্থনীতির অনেক সংকটের কথা বলা হচ্ছিল। সেই ভয়ে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু সেই সংকটগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। যেগুলো বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারাও সক্রিয় হচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কিনতে শুরু করেছেন।
‘নতুন বিনিয়োগের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাতে মুভমেন্ট হচ্ছে, শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে, যার ফলে বাজারে তারল্য তৈরি হয়েছে।'
সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ যাদের
সবচেয়ে বেশি ৭ দশমিক ৩১ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ। শেয়ারটির ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ দর বেড়েছে।
আইসিবির দর ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট।
সামিট পাওয়ার সূচকে যোগ করেছে ২ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এ ছাড়া আইডিএলসি, বার্জার পেইন্টস, বিকন ফার্মা, ইস্টার্ন হাউজিং, ওরিয়ন ফার্মা, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ন্যাশনাল হাউজিং সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৩৪ দশমিক শূন্য ২২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২৪.০৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে গ্রামীণফোনের কারণে। শেয়ারটির দরপতন হয়েছে ১.৭৪ শতাংশ।
এর পরেই ৫.২১ পয়েন্ট সূচক কমেছে বেক্সিমকোর দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
ইউনাইটেড পাওয়ারের দর ০.৮৮ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৪ দশমিক ২৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক, পাওয়ার গ্রিড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী পেপার ও আরএকে সিরামিকসের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৪৫ দশমিক ৮১ পয়েন্ট।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দর বাড়ার শীর্ষে রয়েছে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড। শেয়ারটির দর বেড়েছে ৭ টাকা ৯০ পয়সা বা ৯.৯২ শতাংশ। শেয়ারটি সর্বশেষ ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
কোম্পানিটি ৩ হাজার ৩৩০ বারে ৫২ লাখ ৮০ হাজার ৫৬৪টি শেয়ার লেনদেন করে।
তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অ্যাডভেন্ট ফার্মা। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ২ টাকা ৪০ পয়সা বা ৯.৭২ শতাংশ। শেয়ারটি সর্বশেষ ২৭ টাকা ১০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল হাউজিং। কোম্পানিটির ৪ টাকা ৯০ পয়সা বা ৯.৬৮ শতাংশ বেড়েছে।
শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্য কোম্পানিগুলো হচ্ছে- প্যাসিফিক ডেনিমস, অ্যাপেক্স ফুডস, ওরিয়ন ইনফিউশন, অ্যাপেক্স স্পিনিং, আলিফ ম্যানুফ্যাচারিং, ন্যাশনাল টি ও ইন্দো-বাংলা ফার্মা লিমিটেড।
দরপতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিডি মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং। শেয়ারটির দর ১০ টাকা ৪০ পয়সা বা ৫.১৩ শতাংশ কমেছে।
ফার্মা এইড এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিল। শেয়ারটির দর ১ ৩৭ টাকা ১০ পয়সা বা ৩.৯৯ শতাংশ কমেছে। সর্বশেষ লেনদেন হয় ৮৯৩ টাকা ৬০ পয়সা দরে।
পেপার প্রসেসিং এই তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল। কোম্পানিটির দর ৯ টাকা ৬০ পয়সা বা ৩.৭৮ শতাংশ কমেছে। এদিন শেয়ারটি ২৪৪ টাকা ১০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
এই তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলো হচ্ছে- ভ্যানগার্ড এএমএল রূপালী ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড, নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স, নাহি অ্যালুনিয়াম কম্পোজিট প্যানেল, রহিমা ফুড, ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং, জেএমআই সিরিঞ্জ ও প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্স।