জ্বালানি সাশ্রয়ে সূচি করে লোডশেডিং করার খবরে পুঁজিবাজারে যে ধস দেখা গিয়েছিল, অফিস সূচি পুনর্নির্ধারণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি একদিন করে বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সেই আতঙ্ক দেখা যায়নি। সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড গড়ার পর দিন বাজারে সূচক বাড়ল আরেকটু, কিছুটা বেশি হলো লেনদেনও।
এ নিয়ে চলতি সপ্তাহে টানা তিন আর সব মিলিয়ে টানা ছয় দিন বাড়ল সূচক। লেনদেন হলো গত ১০ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
সোমবার মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারি অফিস সূচি হবে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকে লেনদেন চলবে ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আর পরের দুই ঘণ্টা ব্যাংকের অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
এই সিদ্ধান্ত জানানোর পর দিন সপ্তাহের তৃতীয় কর্মদিবস মঙ্গলবার শুরুই হয় শেয়ারের দর ও সূচক বাড়ার মধ্য দিয়ে। শুরু থেকেই লেনদেনের গতি ছিল ভালো।
এর আগে যখন জ্বালানি সাশ্রয়ে প্রথমবারের মতো সূচি তৈরি করে লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়, তার প্রভাবে গত ১৮ জুলাই পুঁজিবাজারে দেখা যায় ধস। সেদিন আতঙ্কে দর হারায় ৩৫২টি কোম্পানি, বিপরীতে বাড়ে কেবল ১০টির দর। দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ বহাল থাকার পরও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সার্বিক সূচকের পতন হয় ৮৭ পয়েন্ট।
তবে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তবে জুলাইয়ের শেষে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট শেয়ারের ক্রয়মূল্যে গণনার বিষয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে জানানো হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমার গণনাও একই পদ্ধতিতে হবে।
এর মধ্যে বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকে এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার অনুরোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর মধ্যে বন্ডের বিনিয়োগ এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখতে বিএসইসির অনুরোধও আছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান শিবলী-রুবাইয়াত উল ইসলাম জানিয়েছেন, এ বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয়।
দীর্ঘ এক যুগ পর পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক মনোভাবের পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্ক কাটতে শুরু করার প্রভাব পুঁজিবাজারে স্পষ্ট। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন থেমে ডলারের দরপতন, যা অর্থনীতির জন্য একটি ভালো খবর হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। সব মিলিয়ে চাপ কাটিয়ে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় সবাই।
অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা কাটতে শুরু করার পর গত সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থেকেই পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে বাড়তে তাকে। সেই সপ্তাহের তিন কর্মদিবসে ৯২ পয়েন্ট এবং চলতি সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ১৮ পয়েন্টের পর দ্বিতীয় দিন আরও ৪০ এর পর তৃতীয় দিন বাড়ল আরও ১৫ পয়েন্ট।
এ নিয়ে টানা ছয় কর্মদিবসে বাড়ল ১৬৭ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজারে টাকা ছয় কর্মদিবস বাড়ল সূচক। লেনদেন হলো গত ১০ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মঙ্গলবারের লেনদেনের চিত্র
সূচক বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনের গতি বৃদ্ধি পুঁজিবাজারে নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় হয়ে উঠার প্রমাণ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর দিন থেকে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অলস বসে থাকা বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনা শুরু করেন চলতি মাসের শুরুর দিকেই। এর মধ্যে সোমবার ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড হয়। সেটিকে আরও একটু ছাড়িয়ে গেল আজ।
১২৩ কোম্পানির উত্থান ও ১৬৯টির দরপতন এবং ৮৯টি আগের দিনের দরে লেনদেন হওয়ার দিন হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৪৮৭ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার টাকার শেয়ার, যা গত ১০ জানুয়ারি লেনদেন হওয়া ১ হাজার ৪৮৭ কোটি ৪৫ লাখ ৪৪ হাজারের চেয়ে কিছুটা কম মাত্র।
চলতি বছর মঙ্গলবারের চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল আট কর্মদিবস।
তবে লেনদেন ও সূচকের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে তাড়াহুড়ো নেই সেটি স্পষ্ট। কোনো একক খাতে হুট করে দর বেড়ে যাওয়ার যে প্রবণতা এক আগে নানা সময় দেখা গেছে, সেটি এবার নেই বললেই চলে।
উত্থানের পুঁজিবাজারে এক দিনে বহু সংখ্যক শেয়ারের দর সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে হাতবদলের চিত্রও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।
কেবল দুটি কোম্পানির দর সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে। আরও তিনটি কোম্পানির দর ৮ শতাংশের বেশি, দুটি করে কোম্পানির দর ৭ শতাংশ, ৬ শতাংশ এবং ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৪টি কোম্পানির দর আর ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৩টির দর।
অন্যদিনে দরপতনের শীর্ষে দেখা গেছে দুর্বল কোম্পানির প্রাধান্য যেগুলোর দর নানা গুঞ্জনে গত কয়েক মাসে বেড়েছে অনেকটাই।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ দর হারানো দুটি কোম্পানিটি দর হারিয়েছে ৭ শতাংশ, ৬ শতাংশ হারিয়েছে একটি, ৩টির দর হারিয়েছে ৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি, ৬টির দর হারিয়েছে ৪ শতাংশের বেশি, ১৩টির দর কমেছে ৩ শতাংশের বেশি।
পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানের বিষয়ে ট্রেজার সিকিউরিটির অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা সাবধানে পা ফেলেছেন। সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করছেন, যার কারণে বাজারের উত্থানটা ধীরে ধীরে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বড় মূলধনি কোম্পানিতে বেশ কিছু ফান্ডের ইনজেকশন লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি স্থায়ী হবে কি-না তা বোঝা যাবে আরও কিছু দিন পর।’
বস্ত্রকে ছাড়িয়ে গেল ওষুধ ও রসায়ন
লেনদেনে এদিন প্রাধান্য ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতের। এক মাসেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো বস্ত্রকে হটিয়ে শীর্ষে উঠে এলো এই খাত। লেনদেন হয়েছে ২৪৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এই খাতে ১৯টি কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১০টির দর। বিপরীতে দুটি কোম্পানি লেনদেন হয়েছে আগের দিনের দরে।
বস্ত্র খাতে লেনদেন হয়েছে ২২৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে নেমে আসার পাশাপাশি কমেছে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদরও। ১৩টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৩১টির দর। ১৫টি লেনদেন হয়েছে আগের দিনের দরে।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিবিধ খাতে লেনদেন হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এই লেনদেনের অর্ধেকই ছিল বেক্সিমকো লিমিটেডের দখলে। আগের দিন ১২৬ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হওয়া কোম্পানিটিতে এদিন হাতবদল হয়েছে ১০৮ কোটি ২৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
প্রকৌশল খাতে লেনদেন হয়েছে চতুর্থ সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা আর খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে ১৪৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এদিন প্রধান খাতগুলোর মধ্যে ওষুধ ও রসায়ন ছাড়া প্রায় সবগুলোতে বেশিরভাগ দর হারিয়েছে।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানির ৬.১২ শতাংশ দরবৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ১৬.৪৬ পয়েন্ট।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮.৪৯ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা। কোম্পানির দর বেড়েছে ২.৭১ শতাংশ।
আর ওরিয়ন ফার্মার দর ৫.৬৪ শতাংশ বৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ৫.৭ পয়েন্ট।
এ ছাড়াও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, আইপিডিসি, লাফার্জ হোলসিম, বেক্সিমকো, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের দরবৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে।
সব মিলিয়ে এই দশটি কোম্পানি সূচকে যোগ করেছে ৫০.০৩ পয়েন্ট।
বিপরীতে ওয়ালটন হাইটেক, তিতাস গ্যাস, পাওয়ার গ্রিড, আরএকে সিরামিকস, ব্রিটিশ আমেরিকার টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, জিপিএইচ ইস্পাত, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, প্রাইম ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের দরপতনে সূচক কমেছে।
এই দশ কোম্পানির কারণে সূচক কমেছে ৩১ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দর বাড়ার শীর্ষে রয়েছে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড । ১ টাকা ৭০ পয়সা বা ১০ শতাংশ বেড়ে শেয়ারটি সর্বশেষ ১৮ টাকা ৭০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
৭৪৩ বারে কোম্পানির ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৯টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ১৭ টাকা ৩০ পয়সা বা ৯.৯৫ শতাংশ। শেয়ারটি সর্বশেষ ১৯১ টাকা ২০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
তৃতীয় স্থানে থাকা সেন্ট্রাল ফার্মার দর ১ টাকা ১০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে ১৩ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
এ ছাড়াও দরবৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে পেপার প্রোসেসিং, রিজেন্ট টেক্সটাইল, বিডি মনোস্পুল পেপার, ইয়াকিন পলিমার, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, বিকন ফার্মা ও ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেড।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি, যেটির দর গত কয়েক মাসে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। শেয়ারটির দর ৮০ পয়সা বা ৬.৭২ শতাংশ কমে সর্বশেষ ১১ টাকা ১০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
১৪৬ বারে কোম্পানির ৩ লাখ ৫ হাজার ২৪৬টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৩৪ লাখ টাকা।
আনলিমা ইয়ার্ন ছিল এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। শেয়ারটির দর ৩ টাকা ২০ পয়সা বা ৭.৪১ শতাংশ কমেছে। লোকসানি কোম্পানিটির সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে সাফকো স্পিনিং মিলস। ২ টাকা বা ৬.৪১ শতাংশ কমে এদিন শেয়ারটি সর্বশেষ ২৯ টাকা ২০ পয়সা দরে লেনদেন হয়।
পতনের তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে রয়েছে- সোনারগাঁও টেক্সটাইল, জুট স্পিনার্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, কেডিএস অ্যাক্সেসরিজ, আরডি ফুড, প্রাইম টেক্সটাইল ও শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।