ডলারের দরের নিম্নগতির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারবান্ধব নানা সিদ্ধান্তের পর ক্রমেই বাড়তে থাকা পুঁজিবাজারে ফিরল আরও প্রাণ। টাকা পাঁচ কর্মদিবসে সূচক বাড়ার পাশাপাশ ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সর্বোচ্চ লেনদেন হলো, যা নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা শুরু করার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবস সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশিরভাগ শেয়ারের দর বৃদ্ধির দিন সূচকে যোগ হলো ৪০ পয়েন্ট, লেনদেন হলো দেড় হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর পুঁজিবাজারে যে ধস নামে, তাতে লেনদেন এক সময়ে চার শ কোটি টাকার ঘরে নেমে আসে।
তবে জুলাইয়ের শেষে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট শেয়ারের ক্রয়মূল্যে গণনার বিষয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে এসব দারুণ খবরের মধ্যেও ৭ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত গোটা সপ্তাহে ১৬৩ পয়েন্টের দরপতনে তৈরি হয় বিস্ময়। পরে জানা যায়, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হচ্ছে, এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। আর তাই আতঙ্কিত হয়ে কেউ শেয়ার বিক্রি করেছেন, তবে ক্রেতারা নিষ্ক্রিয় থাকায় তা বিক্রিও করতে পারছিলেন না।
তবে ১১ আগস্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানায়, ফ্লোর প্রাইস উঠে যাচ্ছে না আর এরপর নতুন সপ্তাহে ১৪ আগস্ট থেকে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। সেই সপ্তাহে কর্মদিবস ছিল তিনটি। তিন দিনই সূচক বাড়ে, সেই সঙ্গে বাড়ে লেনদেন।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিনও এই উত্থান পর্ব অব্যাাহত থাকে। সেদিন ডিএসইএক্স সূচকে যোগ হয় ১৮ পয়েন্ট, যদিও বেশিরবাগ শেয়ার সেদিন দর হারিয়ে লেনদেন হচ্ছিল।
টানা পাঁচ কর্মদিবস সূচক বাড়ার এই চিত্র বিনিয়োগকারীদের মনে স্বস্তি দেবে
তবে সোমবার শুরু থেকেই বেশিরভাগ শেয়ারের দর বাড়তে থাকে। আর বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সূচকে যোগ হতে থাকে আরও পয়েন্ট। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ৪০ পয়েন্ট বেড়ে সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩০০ পয়েন্টে।
এবার উত্থানপর্বে গত বছরের মতো সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। প্রতি দিন কিছু কিছু করে বাড়লে সূচক ও লেনদেন, যা বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার একটি নজির হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
১৬৪টি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১১৭টির দর। আর ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর আগেও যে চিত্র দেখা গিয়েছে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন দরেও বিপুল সংখ্যক শেয়ারের ক্রেতা থাকে না, সেটি আবার দেখা যাচ্ছে। ৯৯টি কোম্পানি লেনদেন হয়েছে আগের দিনের দরে, সেগুলোর সিংহভাগেরই ফ্লোর প্রাইসে ক্রেতা নেই।
লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪৭৭ কোটি ৫৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড, যা কেবল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরেই নয়, ৭ মাস আগে গত ১৬ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। সেদিন লেনদেন ছিল এক হাজার ৫০৬ কোটি ৮০ লাখ ৯ হাজার টাকা।
এই লেনদেন চলতি বছরের নবম সর্বোচ্চ লেনদেন। চলতি বছর সর্বোচ্চ লেনদেন ছিল গত ১১ জানুয়া।ি সেদিন ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ৮৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছিল।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও নিউজবাংলাকে বলেন, 'মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বাড়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া এসব ইস্যুতে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। আরেকটা দল তো আছেই, যারা গুজব ছড়িয়েছিল যে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে তিন সপ্তাহের মধ্যে।
‘এখন যখন তিন সপ্তাহ পরেও বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয় না, বরং ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ছে, রিজার্ভ বাড়ছে, আর শেয়ারের দর কমে ফ্লোর প্রাইসের নিচে যাওয়ার সুযোগ নেই, ফলে বিনিয়োগকারীরা ফিরতে শুরু করেছেন। তারা দেখছেন যে, এখন কিনলে লাভ কতটুকু হবে সেটা হিসাব করা না গেলেও লোকসানের আশঙ্কা কম।’
পুঁজিবাজারে ধসের পেছনে কিছু মানুষের হাত ছিল বলেও মনে করেন রোজারিও। তিনি বলেন, ‘একটা পক্ষ তো ছিলই, যারা চেয়েছিলেন যে, শেয়ারের দাম কমলেই কিনব, তাদের সেই আশা কিছুটা নাই হয়েছে, ফলে তাদেরও কেনা ছাড়া উপায় নাই। সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা আবারও পুঁজিবাজারে ফিরছেন, যার প্রতিফলন লেনদেনে দেখা যাচ্ছে।’
লেনদেনে বস্ত্র, দর বৃদ্ধিতে জীবন বিমা
এদিন শেয়ার দর বৃদ্ধির দিক গিয়ে সব খাতকে ছাড়িয়ে গেছে জীবন বিমা। এই খাতে একটি কোম্পানির দরপতন এবং একটির দর আগের দিনের অবস্থানে ছিল। বেড়েছে বাকি ১১টিরই। সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এই খাতেরই কোম্পানি। অবশ্য সর্বাধিক দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে এই খাতের আর একটিও পাওয়া যায়নি।
দারুণ দিন গেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও। এই খাতে ৩টি কোম্পানির দরপতন, দুটির দর আগের দিনের সমান থাকার মধ্যে বেড়েছে ১৮টির শেয়ার।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে বেড়েছে ২০টি কোম্পানির দর। বিপরীতে কমেছে ৮টির আর আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে ৩টি।
প্রকৌশল খাতে বেড়েছে ২৪টির দর, অপরিবর্তিত ছিল ৫টির দর আর কমেছে ১৩টির দর।
লেনদেনে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া বস্ত্র খাতে ২০টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির দিন হারিয়েছে ২৫টি কোম্পানি আর আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে ১৩টি কোম্পানি।
বস্ত্র খাত রাজা ছিল লেনদেনের দিক দিয়ে। গত এক মাস ধরে প্রতিদিনই শীর্ষে থাকা খাতটির ২৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছেন বিনিয়োগকারীরা, যা মোট লেনদেনের ১৭.৬৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিবিধ খাতেও লেনদেন ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই খাতে হাতবদল হয়েছে ২০৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিংগভাগই বেক্সিমকো লিমিটেডের।
একক কোম্পানি হিসেবে শীর্ষে থাকা এই কোম্পানিটির ১২৬ কোটি ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে এদিন।
শত কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে ওষুধ ও রসায়ন, প্রকৌশল এবং খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতেও। তবে সবচেয়ে বেশি বাজার মূলধনের ব্যাংক খাতে লেনদেন ছিল একেবারেই কম, ৩২ কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে।
সূচক বাড়িয়েছে যারা
সূচকে সবচেয়ে বেশি ৬.১৫ পয়েন্ট যোগ করেছে বিকন ফার্মা। কোম্পানিটির দর ৪.৮৭ শতাংশ দর বেড়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩.৮২ পয়েন্ট যোগ করেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ারদর ১.৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের দর ৭.৭৪ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৩.৫৩ শতাংশ, তিতাস গ্যাসের দর ৩.৫৬ শতাংশ বাড়ায় ৩.২৪ পয়েন্ট এবং ওরিয়ন ফার্মার দর ৬.৯১ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৩.২২ পয়েন্ট।
বার্জার পেইন্টস, পাওয়ার গ্রিড, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ফার্মা ও ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সও সূচকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানিই যোগ করেছে ৩০ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট।
বিপরীতে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের শেয়ারদর ১.৮৪ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৩.৫৫ পয়েন্ট। ব্রিটিশ আরেমিকান ট্যোবাকোর দর ০.৫০ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৩.০৬ পয়েন্ট। ম্যারিকোর শেয়ারদর ০.৯৩ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ১.৬০ পয়েন্ট।
অন্য কোনো কোম্পানি এক পয়েন্ট সূচক কমাতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি সূচক কমিয়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে বাকিগুলো হলো গ্রামীণ ফোন, স্কয়ার ফার্মা, রেনাটা, কেডিএস অ্যাকসেসোরিস, এবি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১১ দশমিক ৮১ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে, এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে ছয়টির দরই বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততটাই।
এর মধ্যে শীর্ষে থাকা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ, ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ৯.৯৯ শতাংশ, সমনা লেদারে দর ৯.৯১ শতাংশ, মেট্রো স্পিনিং মিলসের দর ৯.৮৯ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের দর ৯.৫৬ শতাংশ এবং কেডিএস অ্যাসসেসোরিজের দর বেড়েছে ৯.৫২ শতাংশ বেড়েছে।
শীর্ষ দশে থাকা অন্য চারটি কোম্পানি হলো জিপিএইচ ইস্পাক, ফার্মা এইড, ওরিয়ন ফার্মা এবং ন্যাশনাল পলিমার, যেগুলোর দর ৫.৬২ শতাংশ থেকে ৭.৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
আরও দুটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ছয়টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১২টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ২৯টির দর ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
দরপতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল ফার্স্ট ফাইন্যান্স, যেটি ২০২১ সালে সমাপ্ত অর্থবছরের বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই খবরে কোম্পানিটির শেয়ার দর হারিয়েছে ৫ শতাংশ।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা কে অ্যান্ড হকের দর ৪.৮৮ শতাংশ, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৪.২৪ শতাংশ এবং আগের দিন দর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকা মুন্নু ফেব্রিক্সের দর কমেছে ৪ শতাংশ।
পতনের শীর্ষে দশে থাকা বাকি কোম্পানিগুলো হলো ইনটেক, আইএসএন, এস কে ট্রিমস, আজিজ পাইপ, আইসিবি অগ্রণী মিউচ্যুয়াল ফান্ড এবং কেডিএস লিমিটেড, যেগুলোর সবগুলোর দর কমেছে ৩ শতাংশের বেশি।
আরও একটি কোম্পানির দর ৩ শতাংশের বেশি এবং ১৮টির দর কমেছে ২ শতাংশের বেশি।