গত বছরের নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। দুই দিনের ওই সম্মেলন শেষে ২৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছিল সৌদি আরব, বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনে ওই সম্মেলনে যোগ দেয়া সৌদি আরবের ট্রান্সপোর্ট-বিষয়ক মন্ত্রী তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা পাল্টে গেছে এবং দুই চোখ খুলে গেছে। তিনি এ দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং উন্নতি দেখে ‘বিস্মিত’ হন।
দুই দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন শেষে প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, সিমেন্ট ও ইস্পাতশিল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগের ঘোষণা দেন সৌদি উদ্যোক্তারা। গত কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল, বাংলাদেশে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে আসছে সৌদি আরব। ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনে সৌদি ব্যবসায়ীদের ঘোষণায় আরও আশা জাগায় বাংলাদেশের বেসরকারি খাত।
ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ হিসেবে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বড় অঙ্কের বিনিয়োগের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও মধুর হবে– এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের।
ওই বিনিয়োগ সম্মেলনের পর প্রায় এক বছর হতে চললেও বাস্তবতা হচ্ছে এখন পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসেনি সৌদি আরব। বিনিয়োগের ঘোষণা কাগজেই সীমাবদ্ধ।
সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ঘাটতি অনেক বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ সৌদি আরব থেকে ১০৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে রপ্তানি করেছে মাত্র ২৬ কোটি ডলার। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার দেশে সৌদি বিনিয়োগ বাড়াতে চায়।
বিডা সূত্রে জানা যায়, তিনটি বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয় সৌদি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। কিন্তু একটিরও ইতিবাচক ফলাফল নেই।
গ্যাস সরবরাহ নিয়ে বিলিয়ন ডলারের একটি প্রস্তাব দেয় সৌদি আরব। পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করতে চায় সৌদি আরব। কাতার কিংবা কুয়েত থেকে গ্যাস এনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ গ্যাস সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি।
কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। সরকার বলেছে সরাসরি গ্যাস দিতে হবে। কিন্তু তাতে সম্মত হয়নি সৌদি। ফলে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা আর এগোয়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে সৌদি আরবের দেয়া বিনিয়োগ প্রস্তাব আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা বলেছি, সরাসরি গ্যাস স্লাপাই দিতে হবে। কিন্তু তারা চায় ভারত থেকে। এটা আমরা গ্রহণ করিনি।’
ছাতকে সিমেন্ট কারখানায় ৬০ কোটি ডলার (৬০০ মিলিয়ন) বিনিয়োগ করতে চায় সৌদি আরব। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন বা বিসিআইসির সঙ্গে যৌথভাবে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় তারা।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, ‘প্রস্তাবটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিসিআইসি সিদ্ধান্ত দিতে বিলম্ব করছে। এখনও কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।’
সৌদি আরবের ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন নামের একটি কোম্পানি নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিডা সূত্র বলেছে, তারা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। বেসরকারি খাতের সঙ্গে ব্যবসায় উৎসাহী নয়।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলেছি সরকার ব্যবসা করে না। সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। আমাদের এখানে বেসরকারি খাতে বড় বড় শিল্প গ্রুপ আছে। তাদের সঙ্গে ব্যবসা করলে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। কিন্তু তারা রাজি হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোরিয়ান এক কোম্পানি বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের শোধনাগার স্থাপনে বিনিয়োগ করার জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করেছে। আমি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসেনি।’
একটি সূত্র বলেছে, সৌদি আরব পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ এবং কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলায় আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলেও এখন তারা উৎসাহ দেখাচ্ছে না।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৩৭টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবের কাছ থেকে কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব আসেনি। সঠিক জবাব দিতে পারবে বিডা।’
কেন আসেনি এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু জটিলতা আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি বড় কারণ। বিডাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাপোর্ট পায় না। বিডার কাজ হচ্ছে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। বিনিয়োগ আনা বিডার কাজ নয়। কেউ যদি ওষুধশিল্পের জন্য এপিআই করতে চায়, তার জন্য ওষুধ প্রশাসনকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখবে। মন্ত্রণালয় এগিয়ে না এলে শিল্প হবে কীভাবে?’
তিনি মনে করেন, একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তা বাস্তবায়ন হতে ন্যূনতম দুই-তিন বছর চলে যায়। এক বছরের মধ্যে প্রস্তাব আসতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগ দৃশ্যমান হতে আরও সময় লাগে।
তরুণ এই ব্যবসায়ী শীর্ষ নেতা বলেন, ‘সৌদি আরবের বিশাল ফান্ড আছে। আমরা চাইলে তাদের কাছ থেকে এই ফান্ড থেকে অর্থ আনতে পারি। তবে বিনিয়োগটা হতে হবে অবকাঠামো খাতে এবং বড় প্রকল্পে। তা হলে আমরা লাভবান হব।’