চট্টগ্রামে চারটি ট্রাকস্ট্যান্ড আছে। নিমতলা বিশ্বরোড, মাঝিরঘাট, মাদারবাড়ি ও ফকিরহাট। মাঝিরঘাট ট্রাকস্ট্যান্ডে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাকের যাতায়াত থাকলেও গত বুধবার বিকেল থেকে সংখ্যাটি প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।
কাঁচামাল নিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আসার অপেক্ষায় ব্যবসায়ী জালাল মোল্লা। একে একে বেশ কয়েকটি ট্রাকের সঙ্গে কথাবার্তা হলো তার। ভাড়ায় মেলে না। দেখলেন ট্রাকস্ট্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের পণ্য অপেক্ষমাণ। তবে লোডিংয়ের জন্য ওই সময় ট্রাকের ঘাটতি।
মঙ্গলবার রাতে পাঁচ টন ধারণক্ষমতার যে ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা, সেটি বুধবার রাতে ঢাকায় আসতে দাম হাঁকায় ১৮ হাজার টাকা। দরদাম শেষে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ১৭ হাজার টাকায় রফা হয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে যাত্রাবাড়ী কাঁচামালের আড়তের এই ব্যবসায়ী জানান, অসন্তোষ থাকলেও গণপরিবহন সেবায় বাস, লঞ্চ কিংবা রেলে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নির্ধারিত। পণ্য পরিবহনে সেটি নেই। পণ্য পরিবহন দেশের অর্থনীতি সচল রাখলেও ভাড়া নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে রাখা। সরকার এখানে হস্তক্ষেপ না করায় পণ্য পরিবহনে ভাড়া নির্ধারিত হয় চাহিদার ভিত্তিতে। ফলে সুযোগ পাওয়ামাত্র ট্রাকের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়।
নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে পাঁচ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকপ্রতি ভাড়া ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এখন জ্বালানির দাম বাড়ায় ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ হাজার টাকা। ফাইল ছবি
এই পরিস্থিতি শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে নয়, সারা দেশে স্বল্প ও দূরপাল্লার সব ট্রাকস্ট্যান্ডে একই দশা। শুধু জালাল মোল্লা নন, পণ্য পরিবহনে এই বাড়তি খরচ সব ব্যবসায়ীকেই মেনে নিতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে পাঁচ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকপ্রতি ভাড়া ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এখন জ্বালানির দাম বাড়ায় ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ হাজার টাকা। এখন সেই বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে পরিবহনের (ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান) ঘাটতি তৈরি হলে অতিরিক্ত গুনতে হয় আরও তিন হাজার টাকা। শুধু তা-ই নয়, পরিবহনের ঘাটতি যত প্রবল হয়, ভাড়াও তত বাড়তে থাকে। এই বাড়তি ভাড়া ব্যবসায়ীরা সমন্বয় করে নেন সংশ্লিষ্ট পণ্যের দামের সঙ্গে। ফলে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাকে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, পণ্য পরিবহনে স্বল্প কিংবা দীর্ঘ কোনো দূরত্বে সরকার ভাড়া নির্ধারণ করে না দেয়ায় নিয়মে বাঁধা ছক এখানে চলে না। আবার বেসরকারিভাবেও কোনো একটি সংগঠনের একক নেতৃত্বে এটি পরিচালিত হচ্ছে না। এ খাতে ভাড়া নির্ধারণের ফয়সালা হয়ে থাকে চাহিদার ভিত্তিতে। চাহিদা যত বাড়ে, ভাড়াও তত বাড়ে। একইভাবে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি হলে এ খাতের পরিবহন মালিকরা ভাড়াও বাড়ান তাদের ইচ্ছামতো।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পণ্য পরিবহনে ছয় চাকার গাড়িতে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়ানোয় খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৪০ টাকা থেকে ২ হাজার ৩৮০ টাকা। কিন্তু পরিবহন কোম্পানিগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা। একইভাবে নৌপথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় দেড় থেকে দুই হাজার টন পণ্যবাহী জাহাজে টনপ্রতি বাড়তি পরিবহন খরচ হচ্ছে ৫১ থেকে ৫৬ টাকা। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০৫ টাকা পর্যন্ত। এভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে পরিবহন কোম্পানিগুলো প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া নিচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে ভোক্তার ভোগ ও ব্যবহার্যের সব কিছু জড়িত, যা চক্রাকারে পণ্যের দামে সমন্বয় হয়ে ভোক্তার কাঁধে চাপে। তাই সরকারকে পণ্য পরিবহনেও যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণে নজর দিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার জানান, পণ্য পরিবহনে ভাড়া নির্ধারণ সরকার করে না। এটা একেক রোডে একেক রকম। পরিবহনের ধরনেরও পার্থক্য আছে। যার যার সংগঠন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভাড়ার একটি ন্যূনতম হার নির্ধারণ করে, যার থেকে কম হতে পারবে না। সেটিই নিয়মিত ভাড়া হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব বলেন, ‘ট্রাকভাড়া অনেকটা কাঁচামালের দামের মতো ওঠানামা করে। এটা নির্ধারিত হয় চাহিদার ভিত্তিতে। কারণ দেশে সড়ক যোগাযোগে যানজট নিত্যসঙ্গী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হয়। এ কারণে পণ্যের আড়তগুলোর সামনে প্রায় সব সময় লোডিংয়ের চাহিদা অনুযাযী ট্রাক পাওয়া যায় না। তখন পণ্য লোডিংয়ে চাপ বাড়ে। সেই ক্ষেত্রে ট্রাকের ভাড়াও বাড়ে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও হচ্ছে।’
কাঁচামালের ক্ষেত্রেই যত বাড়তি চাহিদা
শাক-সবজি, ফলমূল থেকে মাছ-মাংস কিংবা দুধ, ডিম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও মসলা– এ সবই হলো কাঁচামাল। দৈনন্দিন জীবনে সব শ্রেণি-পেশার ভোক্তার অতি আবশ্যকীয় পণ্য। সারা দেশ থেকে এসব পণ্যের প্রতিনিয়ত জোগান আসে ঢাকায়।
তবে এসব নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা সাধারণত প্রতি সপ্তাহে এক বা দুইবার দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারি দরে পণ্য আড়তে তোলেন। এরপর তা দুই-তিন বা সপ্তাহজুড়ে বিক্রি করেন। ফলে তাদের নিয়মিত পরিবহনের দরকার পড়ে না। কোনো ট্রাক মালিকের সঙ্গে নিয়মিত চুক্তি না থাকায় ট্রাক মালিক বা চালকরাও তাদের ওপর এককভাবে নির্ভর করেন না। একজনের পণ্য সরবরাহ শেষ হওয়া মাত্র আরেকজনের পণ্য তুলতে ব্যস্ত থাকেন। ফলে এসব কাঁচামাল পরিবহনে ভাড়াও বেশি হয়ে থাকে।
এ কারণে ৩০ থেকে ৪০ টাকার সবজি এখন ৬০ থেকে ৮০ টাকায় উঠেছে। ২০০ টাকা কেজির মাছ ৩২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মুরগি ও ডিমের দামে চলছে অস্থিরতা। অন্যান্য ভোগ্যপণ্য ও ব্যবহার্য পণ্যেও দামের বৃদ্ধি ঘটেছে।
চাপ তুলনামূলক কম শিল্পপণ্যে
ব্যতিক্রম দেশে শিল্পোদ্যোক্তাদের বেলায়। তাদের ব্যবসার প্রাণ দেশের বিভিন্ন বন্দর কিংবা সারা দেশের ভোক্তা। শিল্প-কারখানায় ২৪ ঘণ্টাই চলে উৎপাদন। সারা দেশে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে উৎপাদিত পণ্য বা মালামাল সরবরাহ দেয়াই এসব কারখানার মূল লক্ষ্য থাকে।
তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিবহন কোম্পানির সঙ্গে বছরভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করে থাকে। এতে খোলাবাজারের তুলনায় ভাড়ার পরিমাণ কম থাকে। আবার ট্রাকস্ট্যান্ডে ট্রাকের যতই ঘাটতি দেখা দিক, তাতে কোম্পানির পণ্য আনা-নেয়ায় কোনো প্রভাব পড়ে না। নতুন করে দরদামও করতে হয় না।
তবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্পপণ্য পরিবহনের আগের চুক্তিতে পরিবর্তন এসেছে। এ ক্ষেত্রে চুক্তির ভাড়া কিছুটা বেড়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া ৫ শতাংশ, খাদ্যপণ্য, রড, ইস্পাত, সিমেন্ট খাতে খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ৭ শতাংশ। আমদানি ও রপ্তানিতে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পপণ্যেরও একইভাবে দাম বেড়েছে।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে পণ্য পরিবহনে ছয় চাকার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে। ফলে তাদের নিয়মিত চুক্তিতেও বাড়তি ভাড়া সমন্বয় করতে হয়েছে।