ডলারের বাজারে অস্থিরতার পেছনে ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়ে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এফবিসিসিআই।
রোববার বঙ্গবন্ধুর এসএমই উন্নয়ন ভাবনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট শীর্ষক সেমিনারে এই ক্ষোভ ঝাড়েন তারা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন।
অস্থিরতা দূর করতে ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে মুনাফার সিলিং নির্ধারণ করে দেয়ার প্রস্তাব করেন ব্যবসায়ী নেতারা। অবশ্য একই দিন এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ডলার কেনার চেয়ে বিক্রিতে এক টাকার বেশি মুনাফা করা যাবে না।
সেমিনারে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর কোনো ডিসিপ্লিন নাই। ডলার নিয়ে তারা যা খুশি তাই করছে। ডলারকে রাখিমালের ব্যবসার মতো করে ফেলা হয়েছে। আপনি পণ্য কিনবেন, রেখে দিবেন, লাভ হবে -তারপর বিক্রি করে দেবেন। ঠিক ডলারকেও পণ্যের মতো লাভ করার আশায় কিনে রাখছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনাবেচা কেন সিলিং করে দিচ্ছে না। যে রেটে ডলার কেনা হয়, তার থেকে এক দুই টাকা বেশি বিক্রি করতে পারবে না- কেন এমন বাদ্যবাধকতা বেঁধে দিচ্ছে না? অতি দ্রুত ডলারের সিলিং বেঁধে দিতে হবে। তা না হলে ডলার নিয়ে যেভাবে খেলা খেলছে তারা, দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল।’
বাংলাদেশ ব্যাংকে উদ্দেশ করে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, ‘অবিলম্বে ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। কারণ, আপনি যখন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছেন তখন অবশ্যই আপনাকে কন্ট্রোল করতেই হবে। আপনি তো একদম ছেড়ে দিতে পারেন না। ছেড়ে দিলে কী হয় তা তো দেখেছেন? কোনো কোনো ব্যাংক একটা ডলার থেকে ৪২৫ পার্সেন্ট প্রফিট করেছে- এটা তো হতে পারে না।’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এসব কথা বলেন এফবিসিসিআইর প্যানেল উপদেষ্টা ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১৮ শতাংশ দেয় দেশের এসএমই খাতে। যা পায় মাত্র ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯১ শতাংশ এসএমই ব্যাংক ঋণের সহায়তা বঞ্চিত। এছাড়াও গত কয়েক বছরে ব্যাংকের মোট ঋণের অনুপাতে এসএমই ঋণের হার কমেছে। যা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এসএমইর উন্নয়ন করে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বিষয়টির উল্লেখ করে সিপিডি পরিচালক বৈষম্যের পেছনে এসএমই খাতের বিকাশ না হওয়াকে দায়ী করেন। জানান, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দেশের এসএমই ঋণের সম্ভাব্য বাজার ২৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ কাঠামোতে এসএমই খাত অবহেলিত। তাই এই বিশাল লাভজনক খাতে ব্যাংকগুলো নজর দিচ্ছে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘শুধু ডলার বিক্রি করে লাভ করার জন্য এতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এটা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।
‘শুধু মুনাফা করাই ব্যাংকের কাজ নয়। তাদেরকে অবশ্যই জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে জন্যই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। নগরাঞ্চলে বড় গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে শহর-গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ানো ব্যাংকের কাজ নয়। বরং উন্নয়ন সুষম করার দায়িত্ব।’
এসএমই নিয়ে সবাই কথা বলে, কিন্তু কোনো কাজ করে না- এমন কথা উল্লেখ করে তিনি সরকারি পর্যায়ের সীমাবদ্ধতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠার আশ্বাস দেন। বলেন, ‘এসএমই ফাউন্ডেশনকে আর্থিকভাবে সক্ষম করতে হবে।’
এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এসএমই খাতের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে উপজেলা পর্যায়ে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে এসএমইর জন্য প্লট বরাদ্দের আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, ‘বড় শিল্প যেভাবে সরকারি নীতি সহায়তা পায়, ছোট উদ্যোক্তারা সেভাবে পান না। কর ও শুল্ক কাঠামোর কারণে তারা স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য না কিনে বিদেশ থেকে আমদানি উৎসাহিত হচ্ছেন।’
সরকারি প্রকল্পের জন্য স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা আরোপের আহ্বানও জানান তিনি।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘এসএমই বিকাশে সরকারের আর্থিক আনুকুল্য ও প্রকল্প আনুকুল্য পাওয়া যায় না। ২০১৯ সালের এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য ২ হাজার ১৪১ কোটি টাকার বাজেট হলেও কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি।
তৃনমূলের এসএমই উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ব্যাংকের শহরের প্রতি তিনটি শাখার বিপরীতে গ্রামাঞ্চলে সাতটি শাখা স্থাপনের নিয়ম করার আহ্বান জানান বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক মোর্শেদ। তিনি জানান, তার ব্যাংকের ৯০ শতাংশ গ্রাহক এসএমই খাতের।
মুক্ত আলোচনায় নারী ক্ষুদ্র ও কুটির উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য সনদ প্রাপ্তি সহজ করা, বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ বন্ধে প্রতিযোগিতা আইন কার্যকর করা, এসএমই খাতে গবেষণা ও পণ্য উন্নয়নে ইনস্টিটিউট স্থাপন করা, সরকারের নীতির কারণে কারখানা বন্ধ হলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে এক্সিট পলিসি প্রণয়ন, শিল্পখাতে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ, প্রকৃত এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণের দাবি জানান বক্তারা।