নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কেনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।
সংস্থাটি বলছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সক্ষমতা যাচাই না করে, যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি না নিয়ে দ্রুত এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে উপকারভোগীর তালিকা, পণ্য ক্রয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পুরোপুরি সুফল পায়নি।
‘টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করে টিআইবি। এ সময় টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে দশ দফা সুপারিশ করে সংস্থাটি।
সংস্থাটি বলছে, প্রকৃত উপকারভোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফ্যামিলি কার্ড তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। বিপরীতে উপকারভোগীদের চাহিদা, পণ্য ক্রয়ের সামর্থ্য এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনা না করায়, এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি তুলে ধরেন একই বিভাগের রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুহা. নূরুজ্জামান ফরহাদ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
গবেষণায় যা বলা হয়
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে মিশ্র পদ্ধতিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ এবং ১৮-২৬ এপ্রিল চালানো হয় জরিপ। এতে ৩৫ জেলার মোট এক হাজার ৪৭ জন উপকারভোগী অংশ নেন।
২০২২ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেয়ার মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকার। করোনাকালে ‘২,৫০০ টাকা নগদ সহায়তা’ কর্মসূচির আওতাভুক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার উপকারভোগীদের রেখে নতুন করে আরও ৬১ লাখ ৫০ হাজার জনকে যুক্ত করা হয়।
জরিপ বলছে, ইতোমধ্যে দুই হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তাপ্রাপ্তদের ৩৯.৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পাননি। এর মধ্যে ৮০.৪ শতাংশ সম্ভাব্য উপকারভোগীকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বাদ দেয়া হয়। জরিপে মোট অংশগ্রহণকারী নারীর ৩৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষের ৩১.৪ শতাংশ উপকারভোগী অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ফ্যামিলি কার্ড পাননি বলে অভিযোগ করেন।
তারা তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রচারে ঘাটতি এবং সুপারিশ বা তদবির জোগার করতে না পারায় সরকারের এ কর্মসূচির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তি, একই পরিবারে একাধিক কার্ড প্রদান, ছবি পরিবর্তন করে তালিকাভুক্তদের কার্ড অন্যদের দেয়া, ঘুষ না দেয়ার কারণে বাদ দেয়ার মতোবিষয়গুলো ওঠে আসে গবেষণায়।
‘২,৫০০ টাকা নগদ সহায়তা’ প্রাপ্ত উপকারভোগীর মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ পরিবারকে কোন বিবেচনায় ও প্রক্রিয়ায় ফ্যামিলি কার্ড দেয়া হয়নি, সেটা স্পষ্ট করা হয়নি বলে গবেষণায় বলা হয়।
জনপ্রতিনিধিদের যোগাযোগ কম এমন ব্যক্তিদের অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। জরিপে উত্তরদাতাদের ৫১.৩ শতাংশ মনে করেন, স্বচ্ছল ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং তাদের স্বজনদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, তালিকাভুক্তি ও কার্ড বিতরণের বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৪ শতাংশ মানুষ। পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওজনে কম দেয়া, ফ্যামিলি কার্ড থাকা সত্ত্বেও পণ্য কিনতে না পারা, দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য না পাওয়া, নির্ধারিত স্থানের পরিবর্তে অন্য স্থানে পণ্য বিক্রয় এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন উত্তরদাতারা।
কার্ড পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭.৫ শতাংশ একবারও পণ্য কিনতে পারেনি এবং ৩.৭ শতাংশের একবার পণ্য কিনতে পেরেছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, দুর্গম অঞ্চল বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, দ্বীপ ও চরাঞ্চল এবং দুর্যোগপূর্ণ হাওর এলাকায় পণ্য সরবরাহে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় টিসিবি।
পণ্য কেনার জন্য গড়ে দেড় ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লাইনে অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপকারভোগী দৈনিক আয় থেকে বঞ্চিত এবং দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বয়স্ক উপকারভোগীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯.২৫ শতাংশ উপকারভোগী জানিয়েছেন, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা ছিল না।
টিসিবি’র ট্রাক বা ডিলারের কাছ থেকে পণ্য কেনার সময় অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১৩.৭ শতাংশ। পণ্য কেনার সময় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে প্যাকেজ মূল্যের অতিরিক্ত ৪০-৫০ টাকা বেশি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে ডিলার ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে বাস্তবে এ উদ্যোগ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। স্বচ্ছতার অভাব, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে প্রকৃত অনেক উপকারভোগী তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। তালিকা প্রণয়ন এবং বিতরণের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। সচ্ছল ব্যক্তিদের একাংশ এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সচ্ছল স্বজনদেরও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এই উদ্যোগে প্রকৃত অর্থে যাদের সুফল লাভ করার কথা, সেই অস্বচ্ছল দরিদ্র নাগরিকরাই বঞ্চিত হয়েছেন।’
টিআইবির সুপারিশ
- উপকারভোগীদের প্রাথমিক তালিকা জনপ্রতিনিধিরা তৈরি করে দেয়ার পর ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা চূড়ান্ত করা।
- নারী, প্রতিবন্ধী, দলিত, আদিবাসী, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা।
- কেবল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ এবং বিতরণের সময়, তারিখ ও স্থানের তথ্য সব পর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
- তালিকাভুক্তি ও কার্ড বিতরণে অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে উপকারভোগীদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- উপকারভোগীদের চাহিদা ও সামর্থ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে প্যাকেজে পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করা।