নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকার বাংলামোটরে এসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সজীব খান। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বাসভাড়া দিতেন ৪০ টাকা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর ২০ টাকা বেড়ে সেই ভাড়া হয়েছে ৬০ টাকা।
অর্থাৎ আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৪০ টাকা। তবে ব্যয় বৃদ্ধির এই হিসাবই শেষ নয়।
গুলিস্তান থেকে বাংলামোটরে আসা-যাওয়া করেন তিনি। আগে এই পথে ভাড়া নিত ১০ টাকা করে। চার কিলোমিটার পথের ভাড়া এখনও ১০ টাকাই হয়। কিন্তু বাসগুলো আদায় করছে ১৫ টাকা করে ৩০ টাকা।
অর্থাৎ এই পথেও ১০ টাকা মিলিয়ে প্রতিদিন সজীবের বাস ভাড়া বেড়েছে ৫০ টাকা। মাসে ২৬ দিন অফিস করলে বাড়তি ব্যয় করতে হবে ১ হাজার ৩০০ টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সবজি, মাছসহ অন্যান্য খাদ্যপণের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে সজীবকে।
তিনি বলেন, ‘মাসে বেতন ২৫ হাজার টাকা। এই বেতন নিয়ে এমনিতেই সংসারে টানাটানি অবস্থা। তার মধ্যে হঠাৎ করেই যদি বাস ভাড়াই ১ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় বাড়ে, তাহলে জীবন ধারণ করাই কঠিন হবে।’
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর বেড়েছে বাস ভাড়া। ছবি: নিউজবাংলা
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। স্কুল, বাজার, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, নৌযান অর্থাৎ জ্বালানি তেলনির্ভর সব যানবাহনে বেড়েছে ভাড়া। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যে।
করোনা-পরবর্তী বিশ্বে যখন নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতি, এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা পৃথিবীকেই ফেলে দিয়েছে বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা, দেশে দেশে মুদ্রার দরপতনে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, তার সঙ্গে বেড়ে যাওয়া খরচের সঙ্গে যখন নাভিশ্বাস, সে সময় জ্বালানি তেলের দামে দিল লাফ।
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা আর অকটেন-পেট্রলের দাম ৪৪ ও ৪৬ টাকা করে বাড়ানোর পর দেশে বাস ভাড়া বেড়েছে নগর পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ৩৫ পয়সা, দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা।
কিন্তু ভাড়া আসলে যতটা হওয়ার কথা, আদায় চলছে তার চেয়ে বেশি। আবার ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি দর। আবার কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১ টাকা বাড়লে ছোট নোটের অভাবে আদায় হচ্ছে ৫ থেকে ১০ টাকা। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ সন্তানদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছে, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছে, কেউবা কম খাচ্ছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি সবজি, মাছসহ অন্যান্য খাদ্যপণের দাম বেড়ে গেছে। ফাইল ছবি
পরিবহন ব্যয়ে লাফ
মিরপুর-১ নম্বর থেকে নিজের মোটরসাইকেলে করে ফার্মগেটে বেসরকারি ব্যাংকে অফিস করেন বিল্লাল হোসেন। বাইকে ৫০০ টাকার তেল নিলে আগে ৬ থেকে ৮ দিন চলাচল করা যেত। এখন সেই পরিমাণ তেল কিনতেই ব্যয় হবে ৬৫০ টাকার বেশি। অর্থাৎ মাসে ব্যয় বাড়বে অন্তত ৬০০ টাকার বেশি।
বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মাসের এই ব্যয় সমন্বয় করতে হবে অন্য কোনো চাহিদা বাদ দিয়ে। বেতন যেহেতু এক টাকাও বাড়েনি, তাই এই ব্যয় সমন্বয় করতে ইচ্ছার মৃত্যু ঘটাতে হবে।’
নিজের বাইক আছে বলে বিল্লালের খরচ তাও কিছুটা কম বেড়েছে। শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব মোড়ের অফিসে যাওয়া আলিম উদ্দিনের বেড়েছে আরও বেশি।
মাঝবয়সী এই ব্যক্তি জানান, বাসেই যাতায়াতের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু যেখান থেকে তিনি বাসে চাপেন, সেখান থেকে ওঠাই কঠিন। মাসের অন্তত ২০ দিনই ব্যর্থ হন। এরপর উপায়ান্ত না দেখে বাইকে করে যান।
তিনি বলেন, ‘আগে বাইকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় যাওয়া যেত। কিন্তু এখন আড়াই শ থেকে ৩০০ টাকা চায়।’
আক্ষেপ করে আলিম উদ্দিন বলেন, ‘সর্বসাকল্যে বেতন পাই ৪২ হাজার টাকা। পথেই চলে যায় বড় অঙ্কের অর্থ। এর সঙ্গে দুই বাচ্চার স্কুলের ব্যয়, সংসারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে চোখেমুখে অন্ধকার অবস্থা। বলেন, মাসের ২০ দিন রাইড শেয়ারে যেতে যদি ৫০ টাকা করে বেশি দিতে হয় তাহলে মাস শেষে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই টাকার সংস্থান কোথা থেকে আসবে?’
ফার্মগেট থেকে মিরপুর ৬০ ফিট রোডের একটি স্কুলে এসে শিক্ষকতা করেন তৌহিদা আহমেদ। ফার্মগেট থেকে টেম্পোতে এতদিন ভাড়া ছিল ২০ টাকা। সেই ভাড়া ৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৬ টাকা।
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই করোনার কারণে স্কুলের বেতন কমিয়ে দিয়েছে, তার পরও আসা-যাওয়ায় এভাবে ব্যয় বাড়লে চাকরি করে লাভ কী?’
মিরপুর ৬০ ফিট রোডের পাকা মসজিদ থেকে মিরপুর-২ নম্বরের মণিপুর স্কুলের মূল শাখায় ছেলেকে টেম্পোতে নিয়ে এবং ফিরতে এতদিন শায়লা ইসলামের ব্যয় হতো ৪০ টাকা। জনপ্রতি ভাড়া ছিল ১০ টাকা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর ভাড়া বেড়ে এখন হয়েছে ৬০ টাকা। জনপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে এখন ভাড়া হয়েছে ১৫ টাকা। অর্থাৎ সামান্য এই পথ যাতায়াতেই দিনে ব্যয় বেড়েছে ২০ টাকা। তাহলে মাসের ২৫ দিন স্কুলে যাওয়া আসায় ব্যয় বাড়ছে ৫০০ টাকা।
ব্যয় সামাল দিতে চাহিদায় কাটছাঁট
রাজধানীর নিকুঞ্জ নিবাসী পার্থ রায় বলেন, ‘মাসে দুই দিন মাংস খাওয়ার রেওয়াজ ছিল পরিবারে। কিন্তু এখন এক দিন খাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’
তিনি বলেন, ‘নিকুঞ্জ থেকে মৌচাক পর্যন্ত যেতে বাস ভাড়া বেড়েছে। বাসে যাওয়া কঠিন হওয়ায় রাইড শেয়ারে যেতে হয়। সেখানেও বাড়তি ব্যয় করতে হবে।’
সংসারে ব্যয়ের খতিয়ান তুলে ধরে বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি খাবারের ব্যয় কমিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না।
তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে বাসা ভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। মে মাসে পানির বিল ৫০০ থেকে এক হাজার করেছে বাসার মালিক। সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে আগে ভাড়া লাগত ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এখন লাগে ৬০-৭০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই বাড়তি। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাস ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে।’
পরিত্রাণ কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। সংসারে পাঁচজন মানুষ। এখন খাওয়া কমিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় কী? আগে সপ্তাহে তিন দিন মাছ খেতাম, এখন সেটা এক দিন করতে হবে। ন্যূনতম পোশাক দিয়ে চলতে হবে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’
‘অনেক ব্যয় কাটছাঁট করে টিকে থাকতে হবে’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমনিতেই মানুষ ব্যয়ের চাপে আছে, তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সামনে এসেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বৃদ্ধিতে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সীমিত আয়ের মানুষ, যাদের আয় নির্দিষ্ট তাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এত কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি কেউ হয়নি। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে, সেটাও জানা নেই।
‘করোনার সময়ে অনেকের আয় কমে যায়। ধারদেনা করে চলার চেষ্টা করেছে সবাই। অনেকে গ্রামে গিয়ে বিকল্পভাবে চলার চেষ্টা করছে। মানুষ যখন একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়া নতুন করে বড় ধাক্কা দিচ্ছে। মানুষ তো কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকবে। পারিপার্শ্বিক অনেক ব্যয় কাটছাঁট করে জীবনযাত্রায় টিকে থাকতে হবে।’