জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ–সিপিডি।
বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক সংলাপে এ প্রশ্ন তুলেছেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল তখন দেশের ভেতরে বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ লাভ করেছে বিপিসি। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে সংস্থাটি জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা গেল কোথায়?’
সরকারি ব্যয়ের স্বচ্চতা নিশ্চিত করতে বিপিসির আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং একইসঙ্গে পুরনো হিসাবের খতিয়ান জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি জানায় সিপিডি।
সিপিডি মনে করে, বিপিসির আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে আসা উচিত। ভোক্তার ওপর দায় না চাপিয়েও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেত।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন, বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রমুখ।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিপিসি বলেছে যে মুনাফার ৩৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে, কীভাবে বিনিয়োগ হয়েছে তার হিসাব হিসাব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কোটি, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ কোটি এবং ২০২১ সালে জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা লাভ হয়েছে বিপিসির। এই লাভের টাকা কোথায় কিভাবে ব্যয় হয়েছে তার সঠিক হিসাব জনগণ জানে না। দেশের স্বার্থে বিপিসির লাভ-লোকসানের হিসাব জানা প্রয়োজন।’
সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘শুনেছি প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু টাকা খরচ হয়েছে। বিপিসি নাকি সবচেয়ে ধনী গ্রাহক। বিপিসির ২৫ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। তাহলে এসব টাকা কার? বিপিসি চাইলে এই সংকট সময়ে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে পারত।’
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল ও পাকিস্তানে বেশি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
‘দাম কাদের চেয়ে বেশি? সিংগাপুর, হংকং ও জার্মানির চেয়ে বেশি। যাদের মাথাপিছু আয় ৫০ হাজার ডলারের কাছাকাছি তাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখন তুলনা করব তখন সে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপট মাথায় রাখাটা জরুরি।’
সিপিডির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে প্রথমেই পরিবহন সেক্টরের ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দেবে।
‘কৃষিজ উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্য আমদানি বেড়ে যাবে। শিল্পের উৎপাদনেও খরচ বাড়বে। তার ফলে ব্যবসার লভ্যাংশ কমে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ধাপে ধাপে সব সেক্টরে খরচ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রায়। বিশেষ করে এর বড় ধাক্কাটা আসবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ওপর।’
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি ও রেশনিং কার্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।