১০ টাকায় যে বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া যেত, সেটির দাম এখন ১৫। বেড়েছে ৫০ শতাংশ। কিন্তু উপকরণের মূল্য আর বাজারজাতকরণের খরচ কি ৫০ শতাংশ বেড়েছে?
তাহলে ৫ টাকা বা ৫০ শতাংশ কেন বাড়ল দাম?
কোমলপানীয়র সবচেয়ে ছোট বোতলের দামও ২০ টাকার জায়গায় হয়েছে ২৫ টাকা। এখানেও বেড়েছে ৫ টাকা।
দুই ক্ষেত্রেই পাঁচ টাকা বাড়ার পেছনে একই কারণ থাকতে পারে, সেটি হলো এক ও ২ টাকার নোটের অভাবে এখন কার্যত নোটের সবচেয়ে ছোট একক হয়ে গেছে ৫ টাকা।
বাংলাদেশে ব্যাংক নোটের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক এক টাকা ও দুই টাকার নোটের অভাবের কারণে দেশবাসী কী পরিমাণ ঠকল সেটির একটি উদাহরণ হতে পারে বাস ভাড়া। কিলোমিটার হিসেবে ভাড়ার এখন হিসাব নেই। ভাড়ার হিসাব কমপক্ষে ৫ টাকা দিয়ে হয়।
১১ টাকা বা ১২ টাকা বা ১৭ টাকা বা ২১ টাকার হিসাব নেই। গুনতে হয় ১৫ না হয় ২০ না হয় ২৫ না হয় ৩০ টাকা-এভাবে। ছবি: নিউজবাংলা
অর্থাৎ ১০ টাকা থেকে বেড়ে ভাড়া ১২ টাকা হয় না, হয়েছে ১৫ টাকা। ১৭ টাকা না হয়ে হয়েছে ২০ টাকা।
কাঁচাবাজারের চিত্রটাও একই রকম। ১১ টাকা বা ১২ টাকা বা ১৭ টাকা বা ২১ টাকার হিসাব নেই। গুনতে হয় ১৫ না হয় ২০ না হয় ২৫ না হয় ৩০ টাকা-এভাবে।
এককালে রিকশা ভাড়াও ৮ টাকা বা ৯ টাকা বা ১০ টাকা বা ১১ টাকা বা এভাবে নির্ধারণ হতো। সেখানেও এখন ১৫ বা ২০-এভাবে ঠিক হয়।
প্রতিদিন রিকশা বা বাসের ভাড়া, বিস্কুট, চানাচুর বা চিপসের মতো ছোটখাট কেনাকাটা, সবজি বা মাছ বা দুধ বা অন্য কোনো নিত্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে এভাবে কত এক বা দুই টাকা চলে যাচ্ছে, দিন শেষে বা মাস শেষে অঙ্কটা কত বড়, সেই হিসাব কষারও সুযোগ নেই। তবে ছোট ছোট অঙ্কগুলো জীবনে বড় চাপ ফেলছে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
দিন শেষে এই এক দুই টাকা করে অঙ্কটা যদি ২০ টাকা হয়, তাহলে মাসে বাড়তি বেরিয়ে যাচ্ছে ৬০০ টাকা। পরিবারের একাধিক সদস্যের যদি এই ক্ষতি হয়, তাহলে অঙ্কটা আরও বড় হয়।
মধুবাগ থেকে লেগুনা করে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টপেজে নামেন আমেনা খাতুন। ভাড়া ৮ টাকা। ১০ টাকা দিতেই ভাংতি নেই বলে জানান হেলপার। দাবি করেও লাভ হয়নি। টেম্পু ছেড়ে চলে যায়।
লেগুনার অন্য যাত্রীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ১০ টাকা দেয়ার পর ২ টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। দুই টাকার নোট এবং কয়েন সংকটে টেম্পু যাত্রী এবং হেলপারের মধ্যে কথা কাটাকাটি যেন নিত্য ব্যাপার হয়ে গেছে।
শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজার থেকে সবজি কেনার পর দোকানি পাবেন ১৮৪ টাকা। রেহানা বেগম ২০০ টাকার নোট দেয়ার পর দোকানি তাকে ফেরত দেন ১৪ টাকা। বাকি দুই টাকা খুচরা নেই বলে জানান তিনি।
শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। রেহানা বলেন, প্রায় প্রতিদিন যাতায়াতে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাসায় অন্যদেরও ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা হচ্ছে। হিসেব করে তিনি বলেন, ‘খুচরার অভাবে প্রতিদিন যদি ১০ টাকা এভাবে চলে যায় তাহলে মাসে প্রায় ৩০০ টাকা।’
একই চিত্র মুদিখানার দোকানেও। সব কেনাকাটার পর দোকানি রফিকুল ইসলামকে জানায়, ‘বিল ২২৪ টাকা। দোকানিকে ২২৫ টাকা দেয়া হলে এক টাকা ফেরত দেয়ার বদলে অনেক ক্ষেত্রে ধরিয়ে দেয়া হয় চকলেট। কেউ আবার বলে, ভাংতি নাই। তখন চলে আসতে হয়।’
ছোট নোটের অভাবের কারণ, ব্যাংকগুলো থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ করা হচ্ছে না। অনেক ব্যাংকও ছোট নোটের চাহিদা না দেয়ায় সংকট বাড়ছে।
প্রতিদিন চলছে বিতণ্ডা
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে ভাংতি টাকার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। বিশেষ করে ১, ২ ও ৫ টাকার প্রয়োজন বেশি।
৬ কিলোমিটারের বাস ভাড়া হওয়ার কথা ১২ টাকা। ছোট নোটের চল থাকলে নেয়া হতে পারত ১২ টাকা। কিন্তু দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা। আবার কখনও কখনও ৫ টাকার নোট না থাকার কথা জানিয়ে আরও বেশি আদায় হচ্ছে।
মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় শিকড় বাসের যাত্রী শিপন আলী বলেন, ‘দুই-এক টাকা করে বাড়তি দিতে হচ্ছে। ভাংতি না থাকার অজুহাতে বেশি টাকা নিয়ে নিচ্ছে বাসওয়ালা।’
আলিফ বাসের যাত্রী রোকেয়া বলেন, ‘এক টাকার কয়েন ছিল এতদিন, কিন্তু এখন তাও পাওয়া যায় না। দুই টাকার নোট খুবই নোংরা।’
বাসের কন্ডাক্টররা বলেন, ‘খুচরা নোট কোথাও পাওয়া যায় না। ভাড়া দিতে ১ টাকা এবং ২ টাকার নোট বেশি দামে কিনে আনতে হয়। তাও পাওয়া যায় না। সরকারও নোট ছাড়ে না। আমরা না পাইলে কেমনে দিমু?দৈনিক এ নিয়ে ক্যাচাল হয়।’
শেওড়াপাড়া বাজার করতে আসা সুমনা ইয়ামমিন বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে ১ ও ২ টাকার নোট দরকার। কিন্তু এই নোটগুলো পাওয়া যায় না। দোকানিরাও দিতে পারে না।’
সাধারণের মানুষের অভিযোগ, ৫ টাকার নোটও এখন বিরল হয়ে গেছে। যাও পাওয়া যায়, তাও জরাজীর্ণ। কয়েন কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তা পকেটে রাখা কঠিন।
তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বাজারে ১ টাকার কাগুজে নোটের সরবরাহ বাড়ানো। এতে বিক্রেতারাও অজুহাত দিতে পারবে না, আবার ক্রেতারাও ঠকবে না।
কেন নেই খুচরা নোট
কয়েন সংকটের পেছনে ব্যাংকের গাফিলতিকেই দায়ী করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বারবার বলেও ব্যাংকগুলোকে এ কাজে উৎসাহিত করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক এই সংস্থা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম ১ টাকার কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়। আর ১৯৭৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সবশেষ ১ টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছিল। বর্তমানে ১ টাকার যে নোটটি বাজারে পাওয়া যায়, সেটি হলো ১৯৭৯ সালের ছাড়া নোট। এর পাশাপাশি রয়েছে ১ টাকার ধাতব মুদ্রা।
১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাজারে আসে ২ টাকার নোট। এরপর আরও কয়েক দফা বিভিন্ন ডিজাইনের ২ টাকার নোট বাজারে আনা হয়। সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ১২ তারিখ নতুন ডিজাইনের ২ টাকার নোট বাজার আসে, যেটি এখনও বিদ্যমান। এর পাশাপাশি রয়েছে ২ টাকার ধাতব মুদ্রা।
১৯৭২ সালের ২ জুন বাজারে প্রথম ৫ টাকার কাগুজে মুদ্রা ছাড়া হয়। এরপর বেশ কয়েকবার এ নোটের ডিজাইন পরিবর্তন হয়। ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর সবশেষ নতুন ডিজাইনের ৫ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়। এখন সেই নোট বাজারে চলমান।
১৯৯৫ সালের ১০ অক্টোবর বাজারে আসে ৫ টাকার ধাতব মুদ্রা। ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর বাজারে আসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্বলিত ৫ টাকার মুদ্রা। বর্তমানে ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকা সরকারি মুদ্রা। বাকিগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট বা মুদ্রা।
সংকট নেই, বলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘টাকা ছাপানোর আগে কী পরিমাণ টাকার দরকার হবে সেটা আগে পর্যালোচনা করা হয়। হঠাৎ করে ছাপানো হয় না। কারণ, টাকা ছাপানোর একটি প্রক্রিয়া আছে। সেভাবেই ছাপানো হয়। পরে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে তা বাজারে ছাড়া হয়।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান ব্যাংকগুলোর গাফিলতির কথা। বলেন, ‘নোট বা কয়েনের সংকট নেই। চাহিদার ভিত্তিতে নোট সরবরাহ করা হয়। তবে ব্যাংকগুলো থেকে চাহিদা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত জটিলতার কারণে এই নোটগুলো নেবার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখানো হয় না।’