জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে বিপুল বৃদ্ধির ঘটনা পাল্টে দিয়েছে অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ। জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই, যেখানে এর প্রভাব পড়বে না।
আকস্মিক এ দাম বৃদ্ধি নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে সব শ্রেণির ভোক্তা ও ব্যবহারকারীকে। সবার মনে প্রশ্ন: জীবনযাত্রার ব্যয় আগামীতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
রপ্তানিকারকরা এখন উদ্বিগ্ন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকা নিয়ে। তবে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় রয়েছেন যেকোনোভাবে বাড়তি দাম পণ্যের ওপর সমন্বয়ের। এদিকে স্থির আয়ের সঙ্গে বাড়তি অস্বাভাবিক ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ভোক্তারা। কারণ তারা ভালো করেই জানেন, সব খাতে মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যয় সমন্বয়ের প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই এসে পড়ে।
খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি শুধু একটি পণ্যের দামের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং এর সঙ্গে পরিবহন, সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও ব্যবহার্য পণ্য, ওষুধ, নির্মাণ শিল্প, পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্প- সব খাতের ভোক্তা ও ব্যবহারকারী সম্পর্কিত। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতির সব খাতে।
হঠাৎ করে জ্বালানির মতো একটি স্পর্শকাতর পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় হতাশ ভোক্তা এবং উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক না হলেও বৃদ্ধির হারটি অস্বাভাবিক। আবার সময়টিও সঠিক নয়। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়ে যাবে পরিবহন ব্যয়। এতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বাড়বে দামও। এতে রপ্তানি শিল্পেও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এটি মানুষের জীবনযাত্রার সব রকম ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। উসকে দেবে মূল্যস্ফীতি। সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে।
যেভাবে প্রভাব ফেলবে এই মূল্যবৃদ্ধি
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা লিটার থেকে এক লাফে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১৪ টাকা। মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ।
৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৬ টাকা লিটারের পেট্রলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩০ টাকা এবং ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৯ টাকার অকটেনের নতুন দাম হয়েছে ১৩৫ টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রথম দিনই ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে শিল্পোৎপাদনে। রপ্তানিমুখী নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ জানিয়েছে, ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের (ডিজেল) মূল্য ৩৪ টাকা বৃদ্ধির ফলে এ খাতের সার্বিক উৎপাদন ব্যয় আগের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
খোদ জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে লঞ্চে জ্বালানি খরচ বাড়বে ৪২ শতাংশ। এ হিসাবে লঞ্চে যাত্রীপ্রতি ভাড়া বাড়বে ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। দূরপাল্লার বাস পরিচালনায় মালিকদের প্রতি কিলোমিটারে খরচ বাড়বে ১০ টাকা ৪৬ পয়সা এবং সিটি বাসের ক্ষেত্রে ১৩ টাকা ৬০ পয়সা। এতে যাত্রীপ্রতি ভাড়া বাড়বে দূরপাল্লার ক্ষেত্রে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ এবং সিটি বাসে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি জ্বালানি ব্যবহার হয় নৌপথে। বিশেষ করে শিল্পপণ্য ও উপকরণ পরিবহন এ পথেই বেশি হয়। তা ছাড়া নৌপথে দেশব্যাপী বালু, ইট-পাথর ও সিমেন্ট বেশি পরিবহন হয়ে থাকে। নির্মাণশিল্পের এসব উপকরণের দামও বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়বে আবাসন খাতে।
তৈরি পোশাক মালিকদের দুশ্চিন্তা
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অস্বাভাবিক হারে জ্বালানির দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তে আমরা চরম হতাশ। শুধু আমরা নই, সারা দেশের মানুষই এতে হতাশ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশের সব খাতে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তা ও ব্যবহারকারীকে আগের চেয়ে বাড়তি মূল্য দিতে হবে। এটি একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয়কে সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় করে তুলবে। এ অবস্থায় আমরা, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ এ বৃদ্ধির কারণে তারাও বেতন সমন্বয়ের দাবি তুলবে, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা প্রস্তুত নই। এর ফলে পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হওয়ার একটা ক্ষেত্র নতুন করে তৈরি হলো।’
ট্রাকে বেড়ে গেছে পণ্য পরিবহনের খরচ
বাংলাদেশ ট্রাক মালিক সমিতির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এখনও হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত না হলেও মোটাদাগে বলা যায়, সড়কপথে কাঁচামাল বা যেকোনো পণ্য পরিবহনেও খরচ ৩৪ শতাংশ বাড়বে।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেয়া হলেও ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে দূরপাল্লার ট্রাক ভাড়া। এতে শনিবার থেকেই ট্রাকের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আগের তুলনায় ভাড়া ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ বাড়তি ভাড়া সমন্বয় করা হচ্ছে পণ্যের দামে।
কাভার্ড ভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মো. মুকবুল আহমেদ বলেন, ‘জ্বালানির দাম বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ১০ টাকা হতে পারে। তাই বলে ৩৪ টাকা? এটা কী করে আমরা সামাল দেব? এই দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক, অস্বাভাবিক। আমরা খুবই মর্মাহত।’
তিনি দাবি করেন, এর প্রভাব সব ধরনের পণ্য পরিবহনে গিয়ে পড়বে। কোনো রকম আয় না বাড়িয়ে দাম বৃদ্ধির এত বড় উল্লম্ফন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে পুরোপুরি দুর্বিষহ করে তুলবে।
অন্যদিকে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনশীল খাতে ঝুঁকি বাড়বে। এটি নির্মাণ খাতকে পিছিয়ে দেবে। সর্বোপরি কম ব্যয়ের নৌপথের খাতটিও ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে চলে যাবে।
মূল্যস্ফীতির চাপ
জীবনযাত্রার সবকিছুতে দাম বৃদ্ধির কারণে গত ফেব্রুয়ারির পর থেকেই টানা পাঁচ মাস মুল্যস্ফীতির চাপে আছে দেশ। সেটি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে জুন মাসে। ওই সময় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঘটে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
জুলাইয়ে সেটি কিছুটা কমে আশার আলো দেখাতে শুরু করলেও হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় মানুষের জীবনযাত্রার এই ব্যয় রাতারাতি বেড়ে গেছে ৩৪ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়য়ের এ উদ্যোগ আরও আগে নিলে ভালো হতো। তাহলে পর্যায়ক্রমে মানুষ এতে সহনশীল পর্যায়ে আসতে পারত। হঠাৎ করে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক ধরনের চাপ তৈরি করবে। এটা একদিকে যেমন সব ধরনের জিনিসপণ্যের দাম বাড়াবে, অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও আরেক দফা বাড়িয়ে দেবে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু বৈশ্বিক অবস্থা ভালো না, সেই ক্ষেত্রে আমাদের বাড়তি দাম মানিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে এখন লোডশেডিংয়ের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের সংকট জ্বালানিতে। বিদ্যুতে নয়। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন লোডশেডিংমুক্ত না করা গেলে সেটি ব্যবসা-বাণিজ্যকে সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, বিষয়টি খুব পরিষ্কার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়বে। পণ্য পরিবহনেও ভাড়া বাড়বে। এই ভাড়া বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সব ধরনের ভোগ্য ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের ওপর। ফলে এটি জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ রিভার ট্রান্সপোর্ট এজেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রাকিবুল আলম দীপু জানান, ‘হঠাৎ করে মার্কেট সার্ভে না করে একটা পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সারা দেশের কর্মকাণ্ডে কী পরিমাণ প্রভাব পড়বে, সেটি পর্যালোচনা করা হয়নি। এ সিদ্ধান্তে দেশের সব জনগণ, তথা অর্থনীতির ওপর পড়বে। সরকারও ভুগবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতেই পারে। কিন্তু তার একটা লিমিটেমশন থাকতে হবে। সামঞ্জস্য রেখে বাড়াতে হবে। এখানে সেটি না করে এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি গোটা অর্থনীতি তথা দেশের সব মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।’