বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এনবিএলের আকাশ থেকে মাটিতে পতন

  •    
  • ৬ আগস্ট, ২০২২ ০৯:৩০

২০১৬ সালে এনবিএল শেয়ারপ্রতি আয় করে ২ টাকা ৮৪ পয়সা। পরের বছর তা কমে হয় ২ টাকা ২ পয়সা। ২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি আয় আরও কমে হয় ১ টাকা ৪৫ পয়সা, যা পরের বছর নেমে হয় ১ টাকা ৪১ পয়সা। ২০২০ সালে আয় আরও কমে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১৮ পয়সায় নামে, যা ২০২১ সালে নামে শেয়ারপ্রতি ১২ পয়সা। চলতি বছরের ছয় মাসে ব্যাংকটি লোকসান করেছে ১৭৩ কোটি টাকা।

২০১০ সালের ডিসেম্বর শেষে শেয়ারপ্রতি আয় ১৫ টাকা ৫৫ পয়সা। আর এক যুগ পর ২০২২ সালের অর্ধবার্ষিক হিসাব শেষে শেয়ারপ্রতি লোকসান ৫৪ পয়সা। এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংক বা এনবিএলের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪৪১ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার ২৮০ টাকা। সে সময় শেয়ার সংখ্যা ছিল ৪৪ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ১২৮টি। ওই বছর ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৬৮৬ কোটি ৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪০ টাকা।

প্রতি বছর বোনাস শেয়ার দিতে দিনে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ারসংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। বর্তমানে পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৭৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭১০ টাকা। শেয়ারসংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৭ টাকা।

এই হিসাবে ছয় মাসে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ১৭৩ কোটি ৮৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬৮ টাকা। লোকসানের এই বৃত্ত থেকে বের হতে না পারলে বছর শেষে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটির শেয়ারদরও কমতে কমতে তলানিতে নেমেছে। ২০১০ সালে শেয়ারদর ছিল ২০০ টাকা ছাড়িয়ে, এখন তা অভিহিত মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমেছে। একপর্যায়ে ৬ টাকাতেও লেনদেন হয়েছে।

সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের অঙ্কটা ৬ হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ।

এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালকদের সঙ্গে দুই দিন আলোচনায় বসেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

যে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে টেনে তোলার কথা গভর্নর বলেছেন, তার মধ্যে তিনি নাম উল্লেখ করেছেন কেবল ন্যাশনালের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা উত্তরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। একে একে ১০ ব্যাংকের সঙ্গে এ রকম সভা হবে। তবে কোনো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে সভা হবে, তা জানি না।’

ব্যাংকটির এই দশার কারণ আকাশচুম্বী খেলাপি ঋণ, যেগুলোর আদায় হওয়ার আশা ক্ষীণ। নামে-বেনামে ঋণ, পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বসহ নানামুখী সংকটে থাকা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দেশের যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি। ফলে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ব্যাংকটির কারণে।

ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে লোকসানি

কোনো একটি কোম্পানির এক বা দুই প্রান্তিক খারাপ হতেই পারে। তবে এনবিএলের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে আগের বছরের চেয়ে খারাপ করেছে ব্যাংকটি।

এনবিএলের পতন শুরু মূলত ২০১২ সাল থেকে। ২০১০ সালে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করার পর শেয়ারসংখ্যা ও পরিশোধিত মূলধন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পর এক বছর অবস্থান অনেকটাই ধরে রাখে ব্যাংকটি।

২০১১ সালে শেয়ারসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৯টি। ওই বছর ব্যাংকটি শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ৭ পয়সা হিসেবে মুনাফা করে ৬০৮ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭৮৯ টাকা। তবে পরের বছর থেকে তা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে।

২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৬ সালে এনবিএল শেয়ারপ্রতি আয় করে ২ টাকা ৮৪ পয়সা। পরের বছর তা কমে হয় ২ টাকা ২ পয়সা। ২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি আয় আরও কমে হয় ১ টাকা ৪৫ পয়সা, যা পরের বছর নেমে হয় ১ টাকা ৪১ পয়সা।

২০২০ সালে আয় আরও কমে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১৮ পয়সায় নামে যা ২০২১ সালে নামে শেয়ারপ্রতি ১২ পয়সা। অর্থাৎ ওই বছর মুনাফা হয় ৩৮ কোটি ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪৮ টাকা।

মুনাফা তলানিতে নামার পর প্রথমবারের মতো পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা এনবিএল থেকে কোনো লভ্যাংশ পাননি। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১৮ পয়সা লোকসান দেয়ার পর দ্বিতীয় প্রান্তিকের অবস্থা আরও খারাপ হয়। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়ায় ৩৬ পয়সা।

অর্থাৎ দুই প্রান্তিক মিলিয়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫৪ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে এই আয় ছিল ২৮ পয়সা।৩০ জুন শেষে এনবিএলের শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১৫ টাকা ৪৯ পয়সা। গত ডিসেম্বরে তা ছিল ১৭ টাকা ২৯ পয়সা।

পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাঁচ গুণ

২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। সেটি বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশই ফিরে আসেনি। এর মধ্যে করোনার দুই বছর ২০২০ আর ২০২১ সালেই খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২২ লাখ টাকা।

২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৭৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

করোনা মহামারির সময় ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়, ২০২০ সালের পুরো সময় ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি হবে না। পরের বছর সুবিধা কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়।

ব্যবস্থাপনা-অনিয়মের অভিযোগ

গত কয়েক মাসে এনবিএলের ঋণসহ নানা বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে ব্যাপক। এবার ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টি উঠে এলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। অনিয়ম থেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও দেয়া হয় ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে।

ব্যাংকের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কিছুদিন কোনো পর্ষদ সভা না হলেও প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।

গত বছরের মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দিয়ে ব্যাংকটিকে নতুন করে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি ব্যাংকটির জন্য বড় অঙ্কের ঋণ ও একক গ্রাহকের ঋণসীমা নতুনভাবে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে নতুন করে ঋণ দিতে হলে ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি বিতরণ করা ঋণ আদায় বাড়ানোর কথা বলা হয়।

এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে ব্যাংকে ঋণসহ নানা অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঋণ বিতরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর আবারও বড় অনিয়ম শুরু হয়।

চলতি বছরের ১২ মে ব্যাংকটি কোন কোন খাতে ঋণ দিতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে এসএমই ঋণ, কৃষিঋণ, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দেয়া ঋণ, জমা থাকা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ, শতভাগ নগদ জমা দিয়ে ঋণপত্র (এলসি) ও অন্যান্য পরোক্ষ ঋণ (নন-ফান্ডেড) সুবিধা।এসব বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ

সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর বেহাল দশায় জর্জরিত কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা উত্তরণে উদ্যোগ নিয়েছেন।

এরই অংশ হিসেবে ১৮ জুলাই এনবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়ে এনবিএলের সার্বিক আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়নের জন্য ২৪ জুলাই এক পর্যালোচনা সভায় যোগ দিতে বলা হয়। ওই সভায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান, এমডি ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাকে (সিএফও) উপস্থিত থাকতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২৪ জুলাই ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভুঁইয়া, পরিচালক খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন, এমডি মেহমুদ হোসেন এবং ২৫ জুলাই ব্যাংকটির পরিচালক রন হক সিকদার ও এমডি মেহমুদ হোসেন গভর্নরের সঙ্গে সভা করেন।

সভায় নিয়মের মধ্যে থেকেই ব্যাংক চালাতে হবে মর্মে কঠোর বার্তা দেন গভর্নর।

আরও বলা হয়, ব্যাংকটির খারাপ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা চুক্তি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। চুক্তিতে ব্যাংকটির সব পরিচালককে সই করতে হবে। এতে তিন বছরে কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে, তা উল্লেখ থাকবে।

এ বিভাগের আরো খবর