পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট হিসাবের ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই ‘বাজারমূল্য’ হিসেবে বিবেচনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে ধন্যবাদ জানিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে এক যুগের দাবি পূরণের পর নিউজবাংলাকে এই প্রতিক্রিয়া দেন বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সম্মতির পরে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যেই এটি কার্যকরের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে তার জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি আশা করছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির জন্য সেটি নিম্নমুখী হবে না। ফলে এই প্রবণতা স্থায়ী হবে এবং পুঁজিবাজার নতুন উচ্চতায় যাবে।
একই মত প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অভিনন্দন জানিয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সমিতি মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিএমবিএ।
সংস্থাটির সভাপতি ছায়েদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিএমবিএর পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। দীর্ঘ দিনের একটি চাওয়া পূরণ হলো।‘
২০২০ সালে বিএসইসির বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর সোয়া এক বছর পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান হয়। এক পর্যায়ে এক দশকের সর্বোচ্চ সূচক আর ইতিহাসের সর্বোচ্চের কাছাকাছি লেনদেন হওয়ার পর তৈরি হয় নতুন আশা।
তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নানা ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসার পর উল্টে যায় পাশার দান।
যে সময় ধারণা করা হচ্ছিল, পুঁজিবাজার আরও উপরে যাবে, সে সময় শুরু হয় দরপতন। টানা পতনের মধ্যে নভেম্বরে বিএসইসি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকের পর এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা পাল্টানোর বিষয়ে দুই পক্ষ দেয় দুই ধরনের বক্তব্য।
শেয়ারের ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার লিমিট বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার
বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে জানান, এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা পাল্টাবে। তখন বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলেও পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় এই ধরনের কোনো কথা হয়নি।
এরপর বাজারে বড় পতনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই পক্ষকে ডেকে আলোচনার কথা জানায়। তবে সেই আলোচনাতেও কোনো সুফল মেলেনি। ৩০ নভেম্বরের সেই বৈঠক শেষে জানানো হয়, ডিসেম্বর শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে বৈঠক শেষে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।
তবে সেই বৈঠক আর হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য একটি সার্কুলারে জানায়, ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও শেয়ারের বিনিয়োগসীমা একইভাবে নির্ধারণ হবে।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসার পর পুঁজিবাজার নিয়ে মনোভাবের পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া যায়। টানা ১৯ বছর একই বিভাগে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হয় যাকে পুঁজিবাজার নিয়ে রক্ষণশীল নীতির জন্য দায়ী করা হয়।
এরপর গত ১৮ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে এক চিঠিকে এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দেয়া হয়।
গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে একটি কৌশলী অবস্থান নেয়া হয়। এতে শেয়াররে বাজারমূল্যকেই ক্রয়মূল্য হিসেবে নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। এতে করে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংজ্ঞা পাল্টানোর আর দরকার পড়বে না। এই সুপারিশ মেনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার সার্কুলার জারি করে।
এর ফলে এখন কোনো ব্যাংক তার বিনিয়োগসীমার মধ্যে শেয়ার কিনলে সেটির দর যতই বাড়ুক না কেন, অযাচিত বিক্রয় চাপ তৈরি হবে না। ব্যাংকগুলোকেও বিনিয়োগসীমা পার হয়ে যাওয়ার ভয়ে জরিমানার জন্য তটস্থ হতে হবে না।
বিএসইসি মুখপাত্র বলেন, ‘এটি কার্যকর হলে ব্যাংকের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সহজ হবে। নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া মার্কেটে আপার ট্রেন্ডে থাকলে সেল প্রেসার আসবে না। এতে করে পুঁজিবাজারের যে আপার ট্রেন্ড রয়েছে তা স্থায়ী হবে। যা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
শেয়ারের ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার গণনার ফলে বাজারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘এটি কার্যকরের ফলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারবে। ফলে বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলে শেয়ার বিক্রি না করলে তারা যে নন-কমপ্লায়েন্সের মধ্যে পড়ত তা আর হবে না। ঊর্ধ্বমুখী বাজারেও ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রির চাপ তৈরি হবে না। যা পুঁজিবাজারে জন্য অত্যন্ত ভালো হবে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী অবশ্য বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এটার নিয়ে যে মানসিক অস্থিরতা ছিল তা দূর হলো। তার চেয়ে বেশি কিছু দেখি না। বিনিয়োগকারীদের তো টাকা দিয়েই শেয়ার কিনতে হবে, না-কি?’