বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থপাচার!

  •    
  • ৪ আগস্ট, ২০২২ ১০:৪১

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।

আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশ খরচ হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আনতে। এই ব্যয়ের আড়ালে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও খতিয়ে দেখা হয় না কখনও।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমদানি ব্যয়ের পুরোটাই যথাযথ নয়। অনেক ভুয়া আমদানিও আছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। তারা মনে করেন, এটি বন্ধ করতে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিদায়ি অর্থবছরে (২০২১-২২) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয় ৫৪৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার, বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির জন্য আগের কোনো বছরই এত ডলারের এলসি খোলেননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৩৮২ কোটি ডলার।

আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশ খরচ হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আনতে। ফাইল ছবি

যেকোনো দেশে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ আছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপ হচ্ছে শিল্প-কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে যন্ত্রপাতি স্থাপন করা। উদ্যোক্তারা যাতে শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত হন, সে জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম শুল্কহার আরোপ করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কহার ১ শতাংশ।

রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কম বা শূন্য শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানিতে আন্ডার এবং ওভার ইনভয়েসিং বেশি হয়। এসব পণ্যে আমদানির ছদ্মাবরণে অর্থপাচার হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত এ ক্ষেত্রে নিয়মিত তদারকি করা।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মূলধনি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানিও রের্কড ৫৮ শতাংশ বেড়েছে গেল অর্থবছরে।

২০২১-২২ অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয় ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে বেশি কাঁচামাল এসেছে তৈরি পোশাক শিল্পে। আগের অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ছিল ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার ৫ শতাংশ।

করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও বেসরকারি খাতে দেশে নতুন বিনিয়োগ হয়নি। এই সময়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা পুনর্বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও লক্ষণীয় নয়।

এ বিষয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তারা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে নতুন শিল্প হয়নি, যা হয়েছে চলমান ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং শিল্প ইউনিটের পুনর্গঠন।

দেশে যখন মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ে, স্বভাবতই বলা যায়, শিল্পায়নের গতি বাড়ছে। কিন্তু পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, লাখ লাখ কোটি টাকার মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে। বিনিয়াগ কোথায়?

বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, মূলধনি যন্ত্রপাতির আড়ালে দেশে থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হচ্ছে। কারা এসব পণ্য আমদানি করছে, পণ্য আনার পর কোথায় ব্যহার করা হচ্ছে– এসব বিষয় খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।

যোগাযোগ করা হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ পাচার একটি বড় অপরাধ। দুদক নানা ধরনের তদন্ত করছে। অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই।’

এ অভিযোগে দুদক তদন্ত করতে পারে কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যদি কোনো টাকা লন্ডারিং হয়, সেটি আমরা খতিয়ে দেখতে পারি, অন্যথায় নয়। আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজ্যান্স ইউনিটের খতিয়ে দেখা উচিত।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা-পরবর্তী তৈরি পোশাক, স্পিনিং, পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প, টেক্সটাইল ও ওষুধ শিল্পে ইউনিট সম্প্রসারণে বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন কোনো খাতে বিনিয়োগ হয়নি।

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘করোনার পর দুই বছর ক্যাপিটাল মেশিনারিজ তেমন আসেনি। সে জন্য বিদায়ী বছরে বেশি আমদানি হয়েছে। সরকারি বড় বড় প্রকল্প, যেমন রূপপুর তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ব্যবহার বেড়েছে।’

করোনার-পরবর্তী বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ হয়নি– এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘করোনার সময় ব্যবসায়ীরা থমকে গিয়েছিলেন। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলে যখন সবাই প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এখন বিনিয়োগ হচ্ছে চলামান ইউনিটের পুনর্গঠনে। কিন্তু নতুন করে কেউ বিনিয়োগের চিন্তা করছে না। কারণ, অর্থনীতি এখনও স্থিতিশীল নয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্যাপিটাল মেশিনারিজের নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করছি না। এটি বন্ধ করতে হলে কঠোরভাবে মনিটর করা উচিত। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’

গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, দুটি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত যেসব পণ্যে কম শুল্ক থাকে, ওই পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হয়। আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বিষয়টি চলে এসেছে। ফলে সরকারের অবশ্যই তদন্ত করা উচিত।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্যাপিটাল মেশিনারজি আমদানি বাড়লে তার প্রতিফলন ঘটবে শিল্পোৎপাদনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কারা আমদানি করছেন, কত দামে আনা হচ্ছে, পরিমান কত– এ সব বিষয় খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কাস্টমস এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, পাঁচভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমেই পাচার হচ্ছে বেশি। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) হয়।

অর্থাৎ কাস্টমসকে ভুল তথ্য দিয়ে অথবা কাস্টমসকে ম্যানেজ করে আমদানি-রপ্তানির প্রকৃত দাম গোপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে সব পণ্যে শুল্ক নেই বা কম, সে ধরনের পণ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার করা সহজ হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে মেশিনের ইউনিটের মূল্যবৃদ্ধি ও স্থানীয় টাকার মান ক্রমাগত কমার কারণে মূলত. মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয় বেড়েছে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওভার ইনভয়েসিংয়ের সুযোগ কম। এগুলো মানসম্মত পণ্য। কাচাঁমাল আমদানিতে সুযোগ আছে। বিশেষ করে ফেব্রিকসে ভুল দাম দেখানোর সুযোগ থাকে। খাদ্যপণ্যেও এ সুযোগ আছে।’

এ বিভাগের আরো খবর