পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে করা যায় কি না, এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে ইতিবাচক সায় দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি কৌশলী পরামর্শ দিয়েছে বিভাগটি। তারা এমন একটি কৌশল করতে চাইছে যাতে এক্সপোজার লিমিটের বর্তমান সংজ্ঞাও ঠিক থাকে আবার কোনো শেয়ারের ক্রয়মূল্যেই তা নির্ধারণ করা যায়।
এক্সপোজার লিমিট বাজার মূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণের বিষয়ে মত জানতে চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ১৮ জুলাই চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুই সপ্তাহ পর চিঠির জবাব দেয়া হয়েছে।
পাল্টা চিঠিতে বলা হয়, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ২৬ ক ধারায় ব্যাংক কোম্পানি কর্তৃক অন্য কোনো কোম্পানির শেয়ার ধারণের হিসাবায়নে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ক্রয়মূল্যকেই বাজার মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।’
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা গণনা করা হয় ক্রয়মূল্য অথবা বাজারমূল্যের মধ্যে যেটি বেশি, সেটি ধরে। এই পদ্ধতিকে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখা হয়।
কোনো ব্যাংক তার বিনিয়োগসীমার মধ্যে শেয়ার কিনলে সেটির দর বেড়ে গিয়ে সীমা অতিক্রম করে গেলেই তা বিক্রি করে দিতে হয়। এতে বাজারে বিক্রির চাপ তৈরি হয়। আর ব্যাংক যেহেতু বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে তাই বিক্রির চাপটাও বেশি থাকে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীর প্রাধান্য বেশি। ব্যাংকের বিক্রয় চাপ তারা সামাল দিতে পারে না।
গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে বৈঠক শেষে জানানো হয়, ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে আরেক দফা বৈঠক হবে। এরপর দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই বৈঠক আর হয়নি।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ফজলে কবির অবসরে যাওয়ার পর গভর্নর হয়ে আসেন আবদুর রউফ তালুকদার।
তিনি পদে আসার আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে ১৯ বছর পর বদলি করা হয়, যাকে পুঁজিবাজার নিয়ে রক্ষণশীল নীতির জন্য দায়ী করা হয়।
এর মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার হিসাব গণনার পদ্ধতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি পুঁজিবাজার নিয়ে সংস্থাটির নীতি পরিবর্তনের আভাস হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কেউ সরাসরি কোনো বক্তব্য দিচ্ছিল না। যদিও গত রোববার বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে নিশ্চিত করেন যে, এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা হবে।
সেদিন তিনি বলেন, ‘এটি এখন প্রক্রিয়াধীন। এটি করার জন্য বর্তমান গভর্নর সচিব থাকার সময় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচের কর্মকর্তাদের আপত্তির কারণে তা হয়নি। তবে এবার হয়ে যাবে।’
এক্সপোজার লিমিটের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নেয়া হতে পারে- এমন ইঙ্গিতও তিনি সেদিন দিয়ে রাখেন। বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে আইন পরিবর্তনের পরিবর্তে অন্য পথের কথা ভাবা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হবে। এ বিষয়টির পাশাপাশি বিএসইসির আরও একটি সুপারিশ আছে। সেটি হলো বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশ্বস্ত করেছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেছেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করতে হলে আইন সংশোধনের দরকার পড়তে পারে। তাই এই কৌশল নেয়া হয়েছে।
বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খান চান ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ হোক। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এক্সপোজার লিমিট গণনা কস্ট প্রাইসে হওয়া উচিত। যে দামে কিনবে সেটাই তার লিমিট।’
তবে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীর মত উল্টো। তিনি বলেন, ‘এক্সপোজার লিমিট বাজারমূল্যে গণনা করা উচিত। বিদ্যমান আইনেই বেশির ভাগ ব্যাংকের এখনো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা করতে চাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ক্রয়মূল্যে গণনা করার পক্ষে মতামত এলে তা বিএসইসির জন্য সাময়িক স্বস্তিদায়ক হবে। তখন প্রচার প্রোপাগান্ডা হবে এবং আবারও বেশি দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
‘একটা জিনিস শুধু করলেই হবে না, দীর্ঘমেয়াদে সেটা কেমন হবে তা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’