বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এরই মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উন্নত বিশ্বেও খাদ্যের দাম বেড়েছে অনেক। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট কাটানোর জন্য চেষ্টা করছে জাতিসংঘ। তবে সংকট সমাধানে কোনো রূপরেখা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
তবে বিশ্বের এই খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এই তিনটি কারণ হলো সারের ঘাটতি, ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূল আবহাওয়া।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে খাদ্য-শস্য উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান সারের বৈশ্বিক চালান ব্যাহত হয়।
রাশিয়া বিশ্বে নাইট্রোজেন সারের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ এবং ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার মিত্র বেলারুশও গুরুত্বপূর্ণ সার রপ্তানিকারক দেশ। এই দুই দেশ মিলেই পটাশিয়াম সারের বৈশ্বিক চাহিদার ৪০ শতাংশের বেশি রপ্তানি করে।
রাশিয়া বছরে মোট ১২.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সার রপ্তানি করত। দেশটির প্রধান ক্রেতার তালিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ব্রাজিল।
বিশ্বে সার রপ্তানিতে শীর্ষ ১০ দেশ
এ ছাড়া মঙ্গোলিয়া, হন্ডুরাস, ক্যামেরুন, ঘানা, সেনেগাল এবং গুয়েতেমালাসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের মোট সার আমদানির পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা একের পর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় সংকটে পড়েছে রাশিয়া থেকে সার আমদানি করা দেশগুলো।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিপদে ফেলেছে বাংলাদেশকেও। এদিকে চীনও সার রপ্তানি না করে মজুত করছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত মাসেই কানাডার কাছে সহায়তা চেয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এক সৌজন্য সাক্ষাতে কানাডার রাষ্ট্রদূত লিলি নিকোলাসের কাছে পটাশিয়াম রপ্তানি অব্যাহত রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিও প্রভাব ফেলেছে সার উৎপাদনে।
এমনকি বাংলাদেশেও গ্যাস সংকটে ২১ জুন বন্ধ হয়ে যায় যমুনা সার কারখানার ইউরিয়া উৎপাদন। দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকলে কারখানা কমান্ডিং এরিয়ায় সার সংকটে আগামী মৌসুমে বোরো আবাদ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় আছেন সার ব্যবসায়ীরা।
এর আগে গ্যাস সংকটে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সার উৎপাদনও ১৯-এ জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে।
সার রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশ চীন। বছরে দেশটি সার রপ্তানি করত ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যেরও বেশি। এখন চীনও বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সার রপ্তানি না করে মজুত করছে। ফলে বৈশ্বিক সার সংকট বাড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন।
এদিকে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর নৌবহর দিয়ে ইউক্রেনীয় বন্দরগুলো অবরোধ, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী খাদ্য রপ্তানির চেনা চিত্র বদলে দিয়েছে।
বিশ্বের গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশের জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। গম বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত ফসলগুলোর একটি। যা রুটি, পাস্তার মতো বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়।
খাদ্য রপ্তানিতে শীর্ষ ৬
এ ছাড়া ইউক্রেন ভুট্টা, বার্লি ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। চলমান সংঘাতের কারণে দেশটির খাদ্যপণ্য রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ইউরোপের বাজারে সূর্যমুখী তেলে পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন বৈশ্বিক বাজারে বছরে প্রায় ৮৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য শস্যের জোগান দেয়।
জাতিসংঘ বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত বছর প্রায় ১০০ কোটি মানুষ খাদ্যাভাবে ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে তাপ, খরা ও বন্যায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ভারতেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০২০ এর এপ্রিল থেকে ২০২১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রাজিলে খরা ও তুষারপাতের ফলে ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে কফির দাম ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়।
এসব সংকটের মুখে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি কৃষি, পুষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা, পানি ও সেচের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ৩০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট খরা ও বন্যায় ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন
খাদ্য সংকট সমাধানে ইউক্রেন যাতে খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে পারে তার জন্য জাতিসংঘ ও তুর্কিয়ের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগরে অবরোধ শিথিল করবে রাশিয়া। এতে ইউক্রেন থেকে জাহাজে করে খাদ্য রপ্তানির পথে আর কোনো বাধা থাকবে না।
চুক্তিটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস।
জাতিসংঘের মতে, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় এই চুক্তি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।