বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে লাভ কী হলো

  •    
  • ৩০ জুলাই, ২০২২ ১০:২৬

সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর করার ঘোষণা এসেছে ২১ জুলাই থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী এক লিটারের বোতল ১৮৫ টাকা আর পাঁচ লিটারের বোতলের দাম হওয়ার কথা ৯১০ টাকা। রাজধানীতে কড়াকড়ির কারণে নতুন দাম কার্যকর হতে দেখা গেলেও মফস্বলের চিত্র ভিন্ন।

রাজিয়া সুলতানা। নওগাঁর বাসিন্দা। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে এক লিটারের বোতল ১৮৫ টাকা নির্ধারণের সাত দিন পর বাজারে গিয়ে হতাশ।

শহরের পৌর খুচরা বাজারে তিনটি দোকান ঘুরেও নতুন দামে কোথাও তেল পেলেন না। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক দোকানি বলছেন নতুন দামের তেল নেই। আগের দামে হলে তেল নিতে পারেন। আমার মনে হয় এক ধরনের প্রতারণা করছেন, তারা বেশি দামে তেল বিক্রির জন্য। এগুলো প্রশাসনের দেখা উচিত।’

শহরের মুক্তির মোড়ে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা হলো মেবারক হোসেনের। তিনিও ২০০ টাকা লিটারে তেল কিনলেন।মোবারক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু বলার নেই, কেউ মানে ঠিকমতো নিয়ম? বাজার মনিটরিং করা দরকার। এখন তেল রেখেই যদি বলে নতুন দামের তেল নাই কী করে বুঝব বলেন?’

সয়াবিন তেলের নতুন দাম কার্যকর করার ঘোষণা এসেছে ২১ জুলাই থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী এক লিটারের বোতল ১৮৫ টাকা আর পাঁচ লিটারের বোতলের দাম হওয়ার কথা ৯১০ টাকা।

খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৬৬ টাকা আর পামঅয়েল বিক্রি করার কথা সর্বোচ্চ ১৫২ টাকা।

দেশের বাজারে যে ঘটনাটি বরাবর দেখা যায়, সেটি দেখা যাচ্ছে আবার। রাজধানীতে কড়াকড়ির কারণে নতুন দাম কার্যকর হতে দেখা গেলেও মফস্বলের চিত্র ভিন্ন। সেখানে কোনো কোনো জেলায় নতুন দামের বালাই নেই, কোনো কোনো জেলায় কেউ আগের দামে কেউ নতুন দামে বিক্রি করছেন। একই জেলায় দেখা গেছে, শহরে নতুন দামে তেল বিক্রি হলেও গ্রামে বেশি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ঘোষণা এলে ব্যবসায়ীরা তা কার্যকর করেন সঙ্গে সঙ্গে। আগের কম দামের পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। কিন্তু কমার ঘোষণা এলে দেখা যায়, এই ব্যবসায়ীরাই আগে বেশি দামে কেনা উল্লেখ করে নতুন দাম কার্যকর করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেন।

গত ২৬ জুন লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে এক লিটারের বোতল ১৯৯ টাকা করার পরও এই চিত্র দেখা গেছে। নতুন দাম কার্যকর হতে সময় লেগে যায় দুই সপ্তাহেরও বেশি।

অথচ আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য যেটি ঘোষণা করা হয়, তখন এর চেয়ে বেশি রাখার কোনো সুযোগই নেই।

রাজিয়ার মতোই নওগাঁর আরেক বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, ‘চারটি দোকান ঘুরে নতুন দামে তেল পেলাম। যে দোকানে যাই তারা বলে তেল নাই, আবার অনেক দোকানি বলছেন আগের দামের তেল আছে। এগুলোর মানে কী?’

মুক্তির মোড় এলাকার রাজন স্টোরের মালিক রাজন আলী বলেন, ‘আমাদের দোকানে আগের দামের তেল ছিল যা বিক্রি করছি আগের রেটেই। সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে নতুন দামের তেল তুলব দোকানে। তারপর সরকার বেঁধে দেয়া দামেই আমরা বিক্রি করব।’

শহরের কেডির মোড়ের খোকন স্টোরের মালিক খোকন হোসেন বলেন, ‘আমার দোকানে আগের দামের তেল এখনও আছে, তাই সেই দামেই বিক্রি করছি। প্রতি লিটার তেল ২০০ টাকা লিটারে বিক্রি করছি।’

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, ‘কোনো ক্রেতা আমাদের অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

কম দামের তালিকা ‘পাননি’ ব্যবসায়ী বিক্রেতা

রংপুর সিটি বাজারে হারুণ স্টোরের কর্মচারী সিরাজ মিয়া দাবি করেছেন, তেলের দাম যে কমেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তালিকা না পাওয়ায় তিনি আগের দামে বিক্রি করছেন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরাও নতুন রেট পাইনি। আগের দরে বিক্রি করছি।’

মকবুল হোসেন নামে মুদি দোকানি জানান, এক লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। কারণ, আগে থেকে কিনে রাখা তেল বিক্রি এখনও শেষ হয়নি। আরেক দোকানি বলেন, সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

বাজারের রংপুর স্টোরের মালিক আশিক আলী বলেন, ‘আমরা বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ের রেটের চেয়েও কম দামে বিক্রি করছি। এখনও নতুন কোনো তালিকা আমরা পাইনি।’তিনি জানান, ফ্রেস কোম্পানির ৫ লিটার তেলের বোতলের গায়ের দাম ৯৯০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করছেন ৯০০ টাকায়। হাফ লিটার তেলের দাম ১০৮ টাকা থাকলেও বিক্রি করছেন ১০০ টাকায়।বাজারে তেল কিনতে আসা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ধাপ্পাবাজির শেষ নেই। তারা বলছে আগে বেশি দামে কিনেছে, তাই এখন বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে করে সরকারি নির্দেশনার দাম থাকল কই?’

মোহাম্মদ আলী নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘যখন দাম বাড়ার খবর ওঠে তখনই দাম বাড়ে । আর এতদিন হলো দাম কমার এখনো ওরা (ব্যবসায়ী) জানেই না তেলের দাম কমেছে। সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া।’রংপুর ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, ‘আমরা বাজার মনিটরিং করছি। বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করা হচ্ছে। কেউ দাম বেশি নিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সবাই দাম না কমালে কমাবেন না সাত্তার

একই চিত্র ময়মনসিংহে। বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর শম্ভুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকেটি দোকানেই নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। অনেক ক্রেতা নতুন দামে কিনতে চাইলেও দিচ্ছেন না দোকানিরা।দোকানি আফজাল মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ২০০ টাকা, পাঁচ লিটার ৯৯৫ টাকা, প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন ১৭৮ টাকা, প্রতি লিটার পাম তেল ১৫২ টাকা ও প্রতি কেজি পাম তেল ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন।

দাম বেশি রাখার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দাম কমানোর আগের দিনও প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি করেছি ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। বর্তমানে দাম কমলেও অনেক ব্যবসায়ী আগের দামেই বিক্রি করছে। তাই আমরাও দাম কিছুটা বেশি রাখছি। তবে একেকজনের কাছ থেকে একেক দাম রাখা হচ্ছে।’

আব্দুস সাত্তার নামে আরেক দোকানি বলেন, সবাই কম দামে বিক্রি করলে তিনিও তা করবেন।

আহসানুল হক নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে দাম বাড়াতেও পারে, কমাতেও পারে। মাঝখান থেকে আমরা সাধারণ ক্রেতারা পড়েছি বিপদে। তারা যে দাম বলে সে দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’

জালাল উদ্দিন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘সব দোহানেই তেলের দাম বেশি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে তেলের দাম কমে আসবে।’

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি রাখা হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

একেকজনের কাছ থেকে একেক দাম আদায়

যশোরে ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই তেলের দাম নিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার শহরের কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দাম কমানোর সিদ্ধান্ত কোথাও কার্যকর হয়নি।

বড়বাজার, চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ড, রেলগেট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা এক লিটার ও পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন যথাক্রমে আগের দাম ১৯৫ ও ৯৬০ টাকায়।শহরের বড়বাজারের মেসার্স তাপস স্টোরের ব্যবসায়ী তাপস কুমার জানান, তিনি অনেক মজুত করেছিলেন। প্রতি এক ও পাঁচ লিটার তেলের বোতল যথাক্রমে ১৯৫ ও ৯৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘আমাদের বেচাকেনার এত তাড়া নেই। এই দামে ক্রেতারা তেল নিলে নিবে না নিলে নাই। আমাদের কিছু করার নাই।’

একই বাজারের ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা লিটার। বোতলজাত ১৯৫ লিটার বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নতুন রেটের তেল এখনও আসেনি। নতুন দামে তেল আসলেই নতুন দামে বিক্রি করব।’

বাহাদুর ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘মূল কথা হলো দেশে সুশাসন নেই। যদি থাকত, তাহলে দাম কমিয়ে দেয়ার পর এখনও সেই দাম কার্যকর হয়নি কেন?’

তহমিনা ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির আগাম খবর জানতে পারলে ব্যবসায়ীর বাড়তি দামে বিক্রি শুরু করেন। দাম কমিয়ে সরকার তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে দরে তারা বিক্রি না করে বাড়তি দরে বিক্রি করছেন।’

সেলিম রেজা নামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় পড়েছি তেলের দাম সরকার কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়তে দেখছি না।’

যশোর ভোক্তা অধিকার সহকারী পরিচালক খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, ‘নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

দাম শহরে কম, গ্রামে বেশি

হবিগঞ্জ শহরে সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। এতে খুশি ক্রেতারা। তবে গ্রাম এলাকায় নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে তেল।

শহরের চৌধুরী বাজারের মহাদেব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মহাদেব সাহা বলেন, ‘বাজারে নতুন তেল এসেছে। তাই আমরাও সরকার নির্ধারিত ১৮৫ টাকা দরেই সয়াবিন তেল বিক্রি করছি।’

একই বাজারের ব্যবসায়ী নিত্য গোপাল বণিক বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যে কারণে এখন ১৮৫ টাকা দরেই বোতলের তেল বিক্রি করছি।’

শহরের রাজনগর এলকার বাসিন্দা পংকজ চৌধুরী বলেন, ‘সয়াবিন তেল ১৮৫ টাকা লিটারেই কিনেছি। ব্যবসায়ীরা বেশি নিচ্ছে না।’

আজমিরীগঞ্জ উপজেলার চিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে প্রতিটি দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ ১৮৫ টাকার তেল বিক্রি করছেন ১৯০ টাকা দরে।

আজমিরীগঞ্জ বাজারের পাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী উগ্রসেন পাল বলেন, ‘ডিলাররা আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে। তাই আমাদেরকেও ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

জরিমানাও হচ্ছে

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করায় দুই ব্যবসায়ীকে ৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বৃহস্পতিবার দুপুরে এ জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খাইরুল ইসলাম। মেসার্স দেওয়ান ব্রাদার্সকে ৫ হাজার টাকা ও মেসার্স নিমাই স্টোরকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

দাম কমেছে কুমিল্লায়

কুমিল্লা শহরে গত সপ্তাহে প্রতি পাঁচ লিটার তেলের বোতল বিক্রি হয়েছে ৯৮০ টাকা দরে। এ সপ্তাহে দাম কমে হয়েছে ৯২০ টাকা।

বৃহস্পতিবার নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার ও বাদশা মিয়ার বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকারের বেঁধে দেয়া দরেই লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে তেল বিক্রি করছেন দোকানিরা।রাজগঞ্জ বাজারের ইশাল মুদি দোকানের মালিক আবু জাহের বলেন, ‘পাঁচ লিটারের প্রতি বোতলে ৬০ টাকা কমেছে। এখন আমরা ৯২০ টাকা দরে বিক্রি করছি।’

কেশব স্টোরের মালিক কেশব সাহা বলেন, ‘আমাদের গোডাউনে এখনো আগের রেটের প্রচুর তেল মজুত আছে। আমরা সেই তেলগুলো এখন বর্তমান রেটেই বিক্রি করছি।’

চকবাজার থেকে পাঁচ লিটার তেল কিনেছেন আবু সাইদ। তিনি বলেন, পাঁচ লিটারে ৬০ টাকা কমলেও দাম অসহনীয় পর্যায়ে। প্রতি লিটার তেল ১০০ থেকে ১২০ টাকা হলে সবার জন্য ভালো হতো।’ কুমিল্লা ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিনই বাজার মনিটরিং করছি। সরকার নির্ধারিত দরের বাইরে বিক্রির অভিযোগ পেলে অবশ্যই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

এ বিভাগের আরো খবর