বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টাকার দরপতনে চেপে বসছে বিদেশি ঋণের ফাঁস

  •    
  • ২৭ জুলাই, ২০২২ ২০:৫৩

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘টাকার দরপতনে আমাদের বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেশি শোধ করতে হবে। আমাদের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।‘

আমেরিকান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতনে বিদেশি ঋণের বোঝা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। দরপতন চলতে থাকলে এই বোঝা আরও বাড়বে। একে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে ডলার। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দর। বুধবার ১০৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে ব্যাংকে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও একই দর। দিন যত যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। ডলার নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।

বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবারও ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৭ দিনে (১ থেকে ২৭ জুলাই) ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশাল অঙ্কের এই টাকা আসবে কোত্থেকে। একটাই পথ আছে, রাজস্ব আদায় বাড়ানো। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? এই প্রশ্নটাকেই সম্ভবে পরিণত করতে হবে।

‘কেননা, এ ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো উপায় নেই। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে (ব্যাংক রেট) টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে। এটাকেই এখন ইন্টারব্যাংক রেট বা ব্যাংক রেট বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে এর চেয়ে ৮/১০ টাকা বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে।

গত বছরের ২৭ জুলাই আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সে সময় বাজার স্বাভাবিক ছিল। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এই রেটে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করত। নগদ ডলার দুই-আড়াই টাকা বেশি দামে বিক্রি করত। খোলাবাজারেও প্রায় একই দামে ডলার কেনাবেচা হতো।

মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি বাড়তে থাকায় আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। এখনও সেটা অব্যাহত আছে। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।

ডলারের বিপরীতে টাকার বিশাল পতন দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলারের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে প্রতি মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে। বড় ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আমাদের। আমদানি কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। ডলার ছুটছে তো ছুটছেই।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, টাকার দরপতনে আমাদের বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেশি শোধ করতে হবে। আমাদের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯ হাজার ৫০০ কোটি (৯৫ বিলিয়ন) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলিয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার।

‘এক বছর আগে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সে হিসাবে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার অঙ্ক ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের রেট ১১০ টাকা দরে যদি আমি হিসাব করি তাহলে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

‘এই সহজ-সরল হিসাব কষেই আমি দেখতে পাচ্ছি, টাকার পতনে এক বছরে আমাদের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়েছে।’

আহসান মনসুর বলছেন, টাকার হিসাবে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘এই ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সেই ডলার তো সরকার বা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের টাকা দিয়ে কিনতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল অঙ্কের সেই টাকাটা কোথা থেকে আসবে?

‘এর উত্তর একদিক থেকে সহজ, আবার কঠিনও। সরকার যদি দ্রুততার সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারে, তাহলে খুবই ভালো সমাধান আসবে। তবে অতীত ইতিহাসও তেমন সুখকর কিছু বলে না। গত কয়েক বছর সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও আমরা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে পারিনি।

‘আরেকটি পথ আছে, করের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানো অথবা গ্যাস-বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল-পানিসহ অন্যান্য সেবার দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমিয়ে দিয়ে সেই টাকায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেবে কি না-সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।’

উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সে কারণেই বলছি, খুবই খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা; দিন যত যাচ্ছে, আমাদের অর্থনীতিতে সংকট তত বাড়ছে।‘

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বেসরকারি খাত। যেসব ব্যবসায়ী গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি ডলার ৮৪/৮৫ টাকা হিসাব ধরে ঋণ নিয়েছে, তাদের এখন ১১০ টাকা দিয়ে ডলার কিনে সেই ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।

‘খুবই খারাপ অবস্থা হবে এ প্রতিষ্ঠানের। এমনও হতে পারে, একটি প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ সারা বছরে যা মুনাফা করেছে তার পুরোটাই চলে যাবে এই ঋণের সুদ-আসল শোধ করতে।’

৫ বছরে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ

অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বিদেশি ঋণ। ৫ বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি (৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন) ডলার।

৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে সেই ঋণ হয় ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণ ৯৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

দেশে এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে বিদেশি ঋণ। ২০১৭ সালের শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে।

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেড়েছে করোনা মহামারির সময়ে। এ সময়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে, যার ৭০ ভাগই স্বল্পমেয়াদি।

এ বিভাগের আরো খবর