খোলাবাজার বা কার্বমার্কেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাংকেও ডলারের দর বাড়ছে। ১০০ টাকার কমে কোথাও মিলছে না ডলার। প্রায় সব ব্যাংকই এখন ১০০ টাকার বেশিতে নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক মঙ্গলবার ১০৭ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে; কিনেছে ১০৫ টাকায়। অর্থাৎ ভ্রমণ, শিক্ষা, জরুরি প্রয়োজন কিংবা চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার যিনি সিটি ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছেন, তাকে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হয়েছে ১০৭ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক মঙ্গলবার ১০২ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৯ টাকা ৮০ পয়সায়। আর রপালী ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য নিয়েছে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা; সোনালী ব্যাংকে ৯৮ টাকা ৬০ পয়সা।
বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১০২ টাকা ২৫ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০১ টাকায়।
খোলাবাজারে মঙ্গলবার ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ১১২ টাকায় উঠেছিল। পরে অবশ্য তা কিছুটা কমে ১১০ টাকায় আসে।
২৬ দিনেই ১০০ কোটি ডলার বিক্রি
বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবারও ৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৬ দিনে (১ থেকে ২৬ জুলাই) প্রায় ১০০ কোটি (এক বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে। বিপরীতে বাজার থেকে ৯ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা) তুলে নেয়া হয়েছে।
তারপরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যতো যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততোই বাড়ছে। পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।
এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না। মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। আর এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়।
অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে ডলার কেনার অবদান ছিল।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, ব্যাংকে তার চেয়ে ৮/১০ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। কার্বমার্কেটে ব্যবধান ১৭ টাকা।
ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে (আন্তব্যাংক দর) ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এনেছে ১০০ টাকায়, আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে ৯৭ থেকে ৯৮ টাকা দামে।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ছিল ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
রিজার্ভ আরও কমেছে
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই দুই বছর পর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। মে মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলঅইয়ের প্রথম ২৪ দিনেই ১৭৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
আর আমদানির ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।