পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।
কার্বমার্কেট বা খোলাবাজারে সোমবার ডলারের দর পৌঁছেছে ১০৬ টাকায়। আগের দিনও এই বাজার থেকে এক ডলার কিনতে খরচ হয়েছিল ১০৫ টাকা।
খোলাবাজারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। বেসরকারি সোশাল ইসলামী ব্যাংক সোমবার ১০২ টাকা ২৫ পয়সায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে; ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০১ টাকায়।
তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৯৮ টাকা ৬০ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৮ টাকা ৫০ পয়সায়। রূপালী ব্যাংক ৯৯ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করছে প্রতি ডলার।
বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। সোমবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও ২৫ পয়সা বেড়েছে। প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে।
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলা বাজারে তীব্র সংকট রয়েছে ডলারের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ডলার পাচ্ছি না। আজ আমি কিনেছি ১০৫ টাকা ৮০ পয়সায়। বিক্রি করেছি ১০৫ টাকা ৯০ পয়সায়। কেউ কেউ ১০৬ টাকায় বিক্রি করেছেন।’
ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম।
এমন অবস্থায় গত ১৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দর ফের ১০০ টাকার ওপরে উঠে যায়। এর পর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে।
দুই মাস আগে ১৭ মে প্রথম খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়ায়। অবশ্য দুই-তিন দিন পর তা ১০০ টাকার নিচে নেমে আসে।
এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের ২৫ জুলাই প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হতো। সোমবার লেগেছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা।
শতাংশ হিসাবে এই এক বছরে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে নগদ ডলারের দর বেড়েছে আরও বেশি।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। আর এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়।
অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ২৫ দিনেই (১ থেকে ২৫ জুলাই) প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারে ডলার সংকট কাটছে না।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকও কমছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই দুই বছর পর এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।