করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যার প্রভাব অনেক দেশের মুদ্রাতেই পড়েছে। ক্রমাগত দাম হারাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। এর বাইরেও সিরিয়া ও লিবিয়ার সংঘাত এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রভাব ফেলেছে অনেক দেশের অর্থনীতিতেই।
ট্রাবলডকারেন্সিসের সিনিয়র ফেলো ও পরিচালক জনহপকিন্স ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ স্টিভ হাঙ্কি গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে দর হারানো মুদ্রার একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন।
যেখানে দেখা যায় ২০২০-এর জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ২২ তারিখ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি মূল্য হারিয়েছে ভেনিজুয়েলার মুদ্রা ভেনিজুয়েলিয়ান বলিভার। গত ৩০ মাসে এই মুদ্রার দাম কমেছে ৯৯.১২ শতাংশ। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটি ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে চলে গেছেন অনেকেই। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুত ভেনিজুয়েলাতেই।
লিরার দাম কমায় সম্পদ রক্ষায় সোনা কেনার প্রবণতা বেড়েছে তুর্কিয়েতে
এরপরের তালিকাতেই রয়েছে জিম্বাবুয়ের ডলারের। ১ ডলারের বিপরীতে জিম্বাবুয়ের ডলার এখন ৯৫০। গত ৩০ মাসে এই ডলারের বিপরীতে এই মুদ্রার দাম কমেছে ৯৭.৬১ শতাংশ। সম্প্রতি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের একসময়ের উন্নত দেশ লেবানন। ঋণের বোঝা, প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ও সর্বশেষ বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণ সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে লেবানিজরা। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব দেশটিকে গ্রাস করে ফেলছে। ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা লেবানিজ পাউন্ডও গত ৩০ মাসে দাম হারিয়েছে ৯২.২৪ শতাংশ।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রভাব ফেলেছে দেশটির অর্থনীতিতে, ফলে কমেছে মুদ্রার মান
গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার মুদ্রার দাম কমেছে ৭৭.২৬ শতাংশ। প্রতি ডলারের বিপরীতে সিরিয়ার মুদ্রা এখন ৪০১০ পাউন্ড।
এদিকে ন্যাটোভুক্ত দেশ তুর্কিয়েতেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্রয়ের কারণে আমেরিকার রোষানলে পড়া, ইউরোপের বিনিয়োগ কমে যাওয়া, দেশটির সরকার বিরোধীরা বলছে, ক্ষমতাসীন এরদোয়ান সরকারের দুর্নীতি ও অদূরদর্শী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দেশটিকে এমন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে দেশটির নাগরিকরা নিজেদের জমানো অর্থের সুরক্ষায় তা দিয়ে ডলার ও সোনা কিনছেন। হাঙ্কির কারেন্সি ওয়াচলিস্টের তথ্য মতে দেশটির মুদ্রার দাম গত ৩০ মাসে ডলারের বিপরীতে কমেছে ৬৬.৫৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৭.৮০ লিরা।
ডলারের বিপরীতে সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থানে রুপি
ডনাল্ড ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে গেলে ইরানের ওপর আবারও পশ্চিমা অবরোধ কার্যকর হয়, যা দেশটির মুদ্রার দামেও প্রভাব ফেলেছে। ইরানিয়ান রিয়েল গত ৩০ মাসে দাম হারিয়েছে ৫৮.২৪ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৩ লাখ ১৯ হাজার ইরানিয়ান রিয়েল পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা রয়েছে অর্থনৈতিক সংকটে। বৈদেশিক ঋণের চাপ সামলাতে পারছে না দেশটি। এমনকি ডলারের অভাবে জ্বালানি তেল কিনতে না পারায় দিনের পর দিন পেট্রল পাম্পের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সেখানকার গাড়িগুলো। এমন পরিস্থিতিতে দাম কমছে শ্রীলঙ্কার রুপি। ৩০ মাসে ৫৪.৩০ শতাংশ দাম কমে এখন ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কান রুপি ৩৯৭.৮২।
মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে পাকিস্তানিদের
জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে পাকিস্তান। দেউলিয়ার হাত থেকে পাকিস্তানকে বাঁচাতে চা পান করার থেকে নাগরিকদের বিরত থাকতে বলেছেন পাকিস্তানের পরিকল্পনামন্ত্রী। আইএমএফ বলছে, দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। এমন পরিস্থিতিতে দাম কমছে পাকিস্তানি মুদ্রারও।
পাকিস্তান তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ব্যবহার করছে। এর কারণ করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বৈদেশিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যাবে।
পরমাণু কর্মসূচির কারণে দেয়া নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক চাপে ইরান
হাঙ্কির তালিকার ভিত্তিতে সর্বশেষ ৩০ মাসে পাকিস্তানি মুদ্রার দাম কমেছে ৩২.২৪ শতাংশ। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি পাওয়া যাচ্ছে ২২৮.৫২।
ভারতীয় রুপির দরপতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার ভারতের মুদ্রার বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রুপি ডলারের বিপরীতে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে এবং প্রতি ডলারের দাম ৮০ রুপি অতিক্রম করেছে।
ভারতীয় রুপির দরপতন এমন একসময়ে ঘটেছে, যখন এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়াতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক) বৈঠক হতে চলেছে।
গত সপ্তায়ই ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে, যেখানে রুপির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দাম ৮০.০৬-এ পৌঁছায়।
সেই হিসাবে বাংলাদেশের টাকার অবস্থান ডলারের বিপরীতে অন্যান্য দেশের মুদ্রার অবস্থানের থেকে অনেক ভালো। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১১.৬০ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৯৪.৪৫ টাকা।