এক সপ্তাহ পরে আবারও বড় পতন দেখল দেশের পুঁজিবাজার। গত সপ্তাহের সোম ও মঙ্গলবারের মতো সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে লেনদেনে এই পতন হয়েছে।
এ নিয়ে টানা ৯ কর্মদিবসে ৩১৪ পয়েন্ট হ্রাসের মধ্য দিয়ে সূচক চলতি বছরের তো বটেই, প্রায় ১৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্থানে নেমে গেল।
রোববার লেনদেনের শুরু থেকেই নিম্নমুখী প্রবণতা ছিল পুঁজিবাজারে। ব্যাপক দরপতনের কারণে ৭৪ পয়েন্ট হারিয়ে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৬ হাজার ৫২ পয়েন্টে।
সূচকের অবস্থান এর চেয়ে নিচে ছিল গত বছরের ২৯ জুন। ওই দিন ডিএসইএক্স ৬ হাজার ৪২ পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সাশ্রয়ী নীতি ঘোষণা ভালোভাবে নেয়নি বিনিয়োগকারীরা। জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ সরকারের গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানোর পরে সপ্তাহজুড়ে পতন দেখা দেয়।
গত সোমবার থেকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে এবং এতেও সামাল দিতে না পারলে দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং, সপ্তাহে এক দিন পেট্রল পাম্প বন্ধ, রাত ৮টার পর দোকান বন্ধের ঘোষণা আসে।
এরপর জেঁকে বসা আতঙ্ক থেকে বের হতে পারেনি পুঁজিবাজার। যদিও একটি ইতিবাচক খবর ছিল। তা হলো- পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা হোক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি বাজারমূল্যে নির্ধারণের নীতিতে অনড় ছিল। নতুন গভর্নর দায়িত্বে আসার পরে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই বিষয়টিও খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি পুঁজিবাজারে। সোম ও মঙ্গলবার বড় ধসের পরে পতন রোধ না হলেও সেই অবস্থা থেকে বুধ ও বৃহস্পতিবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার।
গত সোমবার ও মঙ্গলবারের মতোই তিন শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের দর পতন হয়েছে রোববার। এর বেশির ভাগেরই দর কমেছে দিনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ ও এর আশপাশে। সেই সঙ্গে ক্রেতা ছিল না বিপুলসংখ্যক শেয়ারের।
সোমবার ও মঙ্গলবার সাড়ে ৩০০ করে কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হয়। এর পরের দুই কর্মদিবসে পতন রোধ না হলেও দরপতনের হার কমে আসে।
আজ ৩১৮টি কোম্পানির শেয়ারের দর কমার বিপরীতে বেড়েছে ৪২টির। আর আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ২২টি কোম্পানির শেয়ারের।
ঢালাও দরপতনের কারণে কোনো খাতেই দর বৃদ্ধি দেখা যায়নি। প্রধান খাতগুলোর মধ্যে বস্ত্র খাতে ২৩ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ৩৬ শতাংশ কোম্পানির দর বৃদ্ধি দেখা গেছে।
এর বাইরে আর কোনো খাতে উল্লেখযোগ্য দর বৃদ্ধি ঘটেনি। বিপরীতে ট্যানারি, পেপার ও মুদ্রণ, সিরামিক, সেবা ও আবাসন এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের শতভাগ দরপতন হয়েছে।
এদিকে সূচকের সঙ্গে আগের কর্মদিবসের চেয়ে লেনদেন কমেছে ২০৫ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। দিনভর হাতবদল হয়েছে ৪৭০ কোটি ৯৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ৬৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
লেনদেনের বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ, গ্যাস সাশ্রয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করেছে। বিশ্বের সব দেশেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এর আগে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দেখেনি মানুষ। যার কারণে আতঙ্কেই পুঁজিবাজার পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন কমে শেয়ারের দাম একটা পর্যায়ে এসেছে। আমার মনে হয় যেসব বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিশ্চুপ ছিল তারা অ্যাক্টিভিটি শুরু করবে। বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। বিনিয়োগকারীদের প্যানিকড হয়ে সেল না করে ধৈর্য ধারণ করা উচিত।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের। ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে শেয়ারের সবশেষ দর দাঁড়িয়েছে ৪৩ টাকা ৬০ পয়সা।
২০০১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীদের কোনো বছরেই লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
তবে অজানা কারণেই দর বাড়ছে শেয়ারের। গত ২৫ মে ১৭ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হওয়ার পরে ক্রমাগত বেড়ে বর্তমান দরে অবস্থান করছে।
কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার পরিচালকদের কাছে এবং বাকি অর্ধেক সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।
এর পরেই দর বেড়েছে ফাস ফাইন্যান্সের। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ ৫ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ক্লোজিং দর রোববার দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ দর ৫০ পয়সা বা ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
২০০৮ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে বিনিয়োগকারীদের কখনোই নগদ লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানি। ২০১৯ ও ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি বড় লোকসান দিয়েছে কোম্পানি।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর বেড়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের। গত দুই বছর বড় লোকসানে থাকা কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
এ ছাড়া দর বৃদ্ধির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, সাফকো স্পিনিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, মেট্রো স্পিনিং এবং প্রোগ্রেসিভ ইন্স্যুরেন্স।
দর পতনের শীর্ষ ১০
৫ দশমিক ১৮ শতাংশ দর কমে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেড।
কোম্পানির পর্ষদ ২০২০ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। কোম্পানির করপোরেট ঘোষণা অনুযায়ী রোববার দরপতন বা বৃদ্ধির সীমা ছিল।
ফলে লভ্যাংশ পরবর্তী দর সংশোধনে ওই পরিমাণ দর কমেছে।
বৃহস্পতিবার ৯৫১ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ৯০২ টাকা ৫০ পয়সায়।
এর পরেই সর্বোচ্চ সীমা দুই শতাংশ করে দর কমে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স এবং বার্জার পেইন্টস।
প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স ৬০ টাকা থেকে কমে ৫৮ টাকা ৮০ পয়সা এবং বার্জার পেইন্টস এক হাজার ৭৩৫ টাকা থেকে কমে সর্বশেষ এক হাজার ৭০০ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
এ ছাড়া ২ শতাংশ ও এর আপেপাশে দর হারিয়েছে শীর্ষ দশের সবকটি কোম্পানি। তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে সমরিটা, রিং শাইন, এবি ব্যাংক, বঙ্গজ লিমিটেড, কনফিডেন্স সিমেন্ট, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল এব ফরচুন সুজ।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ১৪ পয়েন্ট সূচক কমেছে রবির কারণে। এ দিন কোম্পানিটির দর কমেছে এক দশমিক ৮৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৩০ পয়েন্ট কমিয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
স্কয়ার ফার্মার দর শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৩ দশমিক ০৪ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বার্জার পেইন্টস, আইসিবি, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, ইউনাইটেড পাওয়ার, ওয়ালটন হাইটেক ও বেক্সিমকো ফার্মার দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০ কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ২৮ দশমিক ৪১ পয়েন্ট।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৭৭ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির দর শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
ট্রাস্ট ব্যাংকের দর ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ পয়েন্ট।
ডাচ্ বাংলা ব্যাংক সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ৩৪ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ।
এ ছাড়া ক্রাউন সিমেন্ট, মাটিন স্পিনিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মেট্রো স্পিনিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স এবং প্রাইম ফাইন্যান্স সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৪ দশমিক ০১ পয়েন্ট।