বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যাংকে ব্যক্তি আমানতের সুদহার হওয়া উচিত ৮ শতাংশের কাছাকাছি। তবে ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার ৫ শতাংশের নিচে থাকাটা এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আবার আমানতের সুদহার যদি ব্যাংকগুলোতে বাড়াতে হয়, সে ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার সব ক্ষেত্রে ৯ শতাংশে সীমিত রাখা ব্যাংকের জন্য কঠিন হয়ে যায়।
এখন বিষয়টি নিয়ে উভয় সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদহারের ছয়-নয় নীতি পর্যালোচনার দাবি তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত না দিলেও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ব্যক্তি ঋণ সুদহারের উচ্চমত সীমা ৯ শতাংশ তুলে নেয়া হতে পারে।
সুদহারের সীমা বেধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই নির্দেশনা
২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ওই সময় থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ সব ধরনের শিল্প, গাড়ি, বাড়ি, আবাসনসহ কোনো ঋণে আর সিঙ্গেল ডিজিটের বেশি সুদ নিতে পারে না ব্যাংকগুলো। তবে আমানতের ওপর ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
করোনা শুরুর আগে দেশের প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংক আমানতের তীব্র সংকটে ছিল। তখন বেশি সুদের অফার দিয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে নিজ দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতায় ছিলেন ব্যাংকাররা।
কিন্তু করোনোর প্রাদুর্ভাবের শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারালে ঋণের চাহিদা যায় কমে। বিনিয়োগ-খরায় দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয় অলস তারল্যের পাহাড়। সে সময় কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার নামায় ২ শতাংশের নিচে।
এই পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট এক সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, মেয়াদি আমানতে কোনো ব্যাংক আর মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদ দিতে পারবে না। তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের জন্য ঘোষিত আমানতের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
তবে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা বর্তমানের মতো ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদহার বেশি রাখতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেটি শুধু ব্যক্তি আমানতের ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের সুদহার সর্বনিম্ন কত হবে, সে বিষয়ে অবশ্য কিছু বলা নেই। আর ব্যাংকে যে টাকা জমা রাখা হয়, তাতে ব্যক্তি আমানতের অবদান শতকরা হিসাবে অর্ধেকেরও কম।
মূল্যস্ফীতি ৬ এর ওপর, এখন কী হবে
সবশেষ হিসেবে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিন মাসের মূল্যস্ফীতির গড় ধরে আমানতের সুদ নির্ধারণ হলেও ঋণ সুদ হার পরিপালন করা নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। কারণ, ঋণের সুদ হার বেঁধে দেয়া হয়েছে ৯ শতাংশ।
ফলে গ্রাহককে বেশি সুদ দিয়ে আমানত রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে ব্যাংক। কিন্তু সেই তুলনায় ঋণ সুদ হার একই অর্থাৎ ৯ ভাগ রাখায়, দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকের স্বাস্থ্য।
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সদ্য যোগদান করা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঋণ-আমানত সুদ হার পর্যালেচনার তাগিদ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুদহার ৯ শতাংশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিল্প ঋণ, উৎপাদনশীল খাত, রপ্তানি সংশ্লিষ্ট খাতের ঋণে ৯ শতাংশ সুদ ঠিকই আছে। তবে এখন মূল্যস্ফীতি বেড়েছে৷ বিলাসজাত পণ্যে ব্যক্তি ঋণের সুদহার পর্যালোচনার দাবি করেছেন বিএবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবে।’
সুদহার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিন্তা ভাবনা করার সময় হয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, পাশাপাশি ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডও বাড়ছে। সুদহার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিন্তা ভাবনা করার সময় হয়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমানতে সুদ দিতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে আরও বাড়বে। এসব কারণে ৯ শতাংশে ঋণ দেয়ায় আমানত-ঋণের গ্যাপটা খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে। সব খাতে না হলেও এসএমই এবং ব্যক্তি ঋণে ছাড় দেয়ার চিন্তা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি বিএবির প্রস্তাবের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। বিভিন্ন ফোরামে এটা নয়ে আলোচনা চলছে। গ্রাহক পর্যায়ে আমাদের তিনটি সেগমেন্ট আছে। এর মধ্যে : কর্মাশিয়াল সেগেমেন্ট বড় করপোরেট গ্রাহক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ও ব্যক্তিগত বা রিটেইল গ্রাহক। এসএমই ও ব্যক্তি ঋণের সুদহারের বিষয়ে পর্যালোচনা করা উচিত।’
সুদহার কত
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মে মাস শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানতে সুদ ৪ দশমিক ০২ শতাংশ আর ঋণের সুদ ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ।
এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ছয় ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আমানতে গড় ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এপ্রিলে যা ছিল ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এসব ব্যাংকের ঋণের সুদ দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এপ্রিলে ঋণে গড় সুদ ছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
বিশেষায়িত তিন ব্যাংক আমানতে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এপ্রিলে যা একই ছিল। এসব ব্যাংকের ঋণের সুদ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এসব ব্যাংকের ঋণের সুদ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে যা ছিল ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বিদেশি নয় ব্যাংকের আমানতে সুদ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ঋণে ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
চড়া মূল্যস্ফীতির পারদ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মে মাসে এই সূচক উঠেছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। জুনে সেই সূচক আরও দশমিক ১৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।
জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মে মাসে হয়েছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়েছে।
সমাপ্ত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩০ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছিল সরকার।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, নয় বছর আগে ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ওই বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২১ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, দেড় বছর পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে ওঠে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। এর প্রতি মাসেই বাড়ছে।