জ্বালানি হলো একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। বলা হয়, এর ব্যবহার যে দেশে যত বেশি এবং ভোক্তাপর্যায়ে তা পাওয়া যত সহজলভ্য, উন্নয়ন-অগ্রগতিতেও সে দেশ তত এগিয়ে। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জ্বালানির ব্যবহারকে বিশ্বব্যাপীই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বিশ্বজুড়েই দুই ধরনের জ্বালানির ব্যবহার হয়- তেলভিত্তিক ও গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি। তেলভিত্তিক জ্বালানির মধ্যে রয়েছে- ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন ও জেট ফুয়েল। আর গ্যাসভিত্তিক জ্বালানির মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তরলীকৃত প্রাকতিক গ্যাস (এলএনজি)।
বাংলাদেশ এর কোনোটিতেই স্বনির্ভর বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফলে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকলেও দেশে এর প্রাপ্তি সবসময় সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।
জ্বালানি নিয়ে দেশে এতদিন বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে সৃষ্ট পরিস্থিতি জ্বালানি ইস্যুতে দেশে আগের সব হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানিতে পরনির্ভরশীল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি প্রাপ্তি এবং ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সেই অনিশ্চয়তা টের পাওয়া যাচ্ছে জ্বালানি ইস্যুতে সরকারের নেয়া নানামুখী সতর্কতামূলক পদক্ষেপে।
জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশই আমদানি
দেশে তেলভিত্তিক জ্বালানি চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশের জোগান আসে স্থানীয় উৎস থেকে। বাকিটা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল।
অন্যদিকে দেশে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে তা স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পুরোপুরি মেটানো সম্ভব হয় না। গ্যাসের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মেটানো হয় স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে। সেখানেও আছে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা।
অর্থাৎ জ্বালানি নিরাপত্তা ইস্যুতে সব সময় বাংলাদেশকে বিদেশ-নির্ভরতা বা বিশ্ববাজারের ওপর ভর করে চলতে হয়। একই সঙ্গে আমদানিতে দেশীয় সক্ষমতার বিষয়টিকেও সব সময় গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। যে কারণে চাহিদার বাকিটা আমদানির মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা হলেও নানা বাস্তবতার কারণে তার সবটা আমদানি করা যাচ্ছে না।
সংকটের উৎপত্তি যেখানে
করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়েই জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। এই বাড়তি চাপের প্রভাবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় পরিশোধিত ও অপরিশোধিত উভয় ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে সৃষ্ট যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আর তা বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আরও উসকে দেয়। ৬-৭ মাস আগে তেলভিত্তিক যে জ্বালানি ব্যারেলপ্রতি ৭০ থেকে ৭১ ডলারে পাওয়া যেত এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ১৭১ ডলারে।
একইভাবে গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ ২০২০ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। ওই সময় স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি (প্রতি এমএমবিটিইউ) আমদানিতে খরচ হতো ৪ থেকে ৫ ডলার। দফায় দফায় বেড়ে এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪০ ডলার। সামনে আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ ২০২০ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। জাহাজ থেকে জাহাজে এলএনজি স্থানান্তর। ফাইল ছবি
জ্বালানি আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ও পেট্রোবাংলা এই বাড়তি অর্থের সংস্থান করতে পারছে না। অন্যদিকে সরকারকেও এই খাতে বছরে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে তেলজাতীয় জ্বালানি পণ্য আমদানিতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে একই সময়ে তা ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ সময়ে এলসি খোলায় ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ১১১ শতাংশ।
আগামীর শঙ্কা মজুত নিয়ে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে ব্যয় সংকোচন নীতিতে হাঁটছে সরকার। কয়েক গুণ দাম বৃদ্ধির বাস্তবতায় ব্যয় অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। অপরদিকে সক্ষমতার অভাবে আগের তুলনায় কমেছে স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহও।
কমছে তেলভিত্তিক জ্বালানির আমদানিও। বেশি দামে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল, পেট্রল, অকটেন আমদানি প্রক্রিয়ায় আগের পরিমাণ ও ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরে চাহিদার তুলনায় ক্রমশ বাড়ছে জ্বালানি তেলের ঘাটতি। আমদানি কমে যাওয়ায় দ্রুত কমছে মজুত। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের নিরাপত্তা মজুত ৪৫ দিন থেকে কমে ৩৫ দিনে নেমে এসেছে।
মজুদ পরিস্থিতির উন্নয়নে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সংকট। এতে জ্বালানি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলায় দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি কেনা এবং তা জাহাজীকরণের মাধ্যমে দেশে এনে খাতওয়ারি ভোক্তাপর্যায়ে বিতরণে আরও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।
জ্বালানির মজুত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিপিসি চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদ এনডিসি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই ক্যালকুলেটিভ বিষয়। হঠাৎ করে মুখস্থ বলাটা কঠিন। কারণ একেকটি জ্বালানির সেফটি ডে ভিন্ন। যেমন: ৪০-৪৫ দিনের ডিজেল মজুত করার সক্ষমতা আছে। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় জ্বালানি বাস্কেট।’
তিনি বলেন, ‘৪০ দিনের মজুদ চিন্তা করে সব সময় কাজ করা হয়। তবে মাঝখানে কোনো একটা সময় হয়তো এটা ৩৫ দিন হয়ে গেছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ ৫ দিন পর দেখা যাবে এটা আবার ৪০ দিন ছাড়িয়ে গেছে।’
বিপিসি চেয়ারম্যান দাবি করেন, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানি ইস্যুতে সব দেশই সংকটে আছে। নানা কারণে আমাদেরও আমদানিতে কিছু সমস্যা আছে, সেটি সাময়িক। জ্বালানি আমদানি অব্যাহত থাকবে। সরবরাহেও কোনো সমস্যা হবে না। সংরক্ষিত মজুদের ঘাটতিও দ্রুত পূরণ হয়ে যাবে। এ নিয়ে সরকার নিখুঁত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে।
দেশে জ্বালানির বর্তমান অবস্থা
চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে জ্বালানির সরবরাহ করে থাকে দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তেলভিত্তিক জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করে বিপিসি। সরকারি এই সংস্থাটির তথ্য বলছে, জ্বালানি তেল ব্যবহারে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭৪তম। সবশেষ ২০২১ সালের জ্বালানি ব্যবহারের হিসাব অনুযায়ী বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার টন। সে হিসাবে দৈনিক জ্বালানি চাহিদা ১৮ হাজার ৬৮ টন। এই সার্বিক চাহিদার মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া যোগান দিয়ে চলে এক মাসেরও কম সময়।
অপরদিকে গ্যাসভিত্তিক জ্বালানির সরবরাহ দেয় পেট্রোবাংলা। সরকারি এই সংস্থার উৎপাদন, বণ্টন ও সরবরাহ চিত্রের হিসাব বলছে, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা আছে ৩৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে দৈনিক উৎপাদন ২৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুট।
ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে দৈনিক এলএনজি আমদানি হয় ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে দৈনিক ৩১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ হিসাবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের দৈনিক ঘাটতি রয়েছে ৫৪০ মিলিয়ন ঘনফুট।
তবে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, দেশে দৈনিক সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ ২ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি নয়। আবার গ্যাসের চাহিদা প্রকৃত অর্থে আরও বেশি। কারণ, যেসব শিল্প আবেদন পড়ে আছে, সেখানে অন্তত হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগবে। আবার দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট আমদানির কথা থাকলেও তা আসছে না। সে হিসাবে ঘাটতি আরও বেশি।
সংকট সামাল দিতে ডিজেল-বিদ্যুতে হাত
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে কয়লা থেকে ৬ দশমিক ৮৯, গ্যাস থেকে ৫০ দশমিক ৮৪, ফার্নেস অয়েল থেকে ২৬ ও ডিজেল থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ৪৪ দশমিক ৮ লাখ টন ডিজেল, ৪৩ দশমিক ৫ লাখ টন ফার্নেস অয়েল, ৩ দশমিক ৭ লাখ টন পেট্রল, ২ দশমিক ৯ লাখ টন অকটেন ও ২ দশমিক ৩ লাখ টন জেট ফুয়েল ব্যবহার হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানির আমদানি খরচে রাশ টানতে সরকার ডিজেলের ব্যবহার কমানোর দিকে নজর দিয়েছে। এ জন্য দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ও এর ব্যবহার কমানো শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক দেশই সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশও এ মাসের শুরু থেকেই স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।
‘শুধু এলএনজি নয়, ডিজেল ব্যবহারও আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি। কারণ আমাদের সবচেয়ে বড় জ্বালানি হলো ডিজেল। বিদ্যুতে এই জ্বালানির ব্যবহার আছে ১০ শতাংশ। বিদ্যুতের এই ১০ শতাংশসহ অন্যান্য খাত থেকে আরো ১০ শতাংশ ডিজেলের সাশ্রয় করতে পারলে দেশে জ্বালানি নিয়ে সমস্যা হবে না।