রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার বিশেষ সুবিধার মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর ফলে বস্ত্র শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমএ এবং তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো বছরজুড়ে ৩০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।
সাধারণভাবে এই দুই সংগঠনের সদস্যরা এই তহবিল থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিতে পারেন না।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে জারি করা এ-সংক্রান্ত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে রপ্তানি বাড়াতে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিটিএমএ ও বিজিএমইএ-এর সদস্যদের জন্য ইডিএফ ঋণের সীমা ২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছিল। ৩০ জুন পর্যন্ত এই সুবিধা পাওয়া যাবে বলে ওই সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
‘এখন সেই সুবিধার মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হলো।’
অর্থাৎ চলতি বছরের পুরোটা সময় এই দুই সংগঠনের একজন সদস্য ৩০ মিলিয়ন ডলার করে ঋণ নিতে পারবেন।
এই সুবিধা বাড়ানোর কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি সার্কুলারে।
তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কম সুদের ইডিএফ ঋণ রপ্তানি আয় বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সে কারণেই করোনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জানুয়ারিতে ওই সুবিধা দেয়া হয়েছিল। ৩০ জুন সেই সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।’
‘এখন আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে রপ্তানি আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। গত অর্থবছরে রপ্তানিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সেই ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতেই এই সুবিধার মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।’
‘এর ফলে রপ্তানি আয় বাড়বে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে,’ বলেন ওই কর্মকর্তা।
একই বিভাগ থেকে জারি করা মঙ্গলবারের আরেক সার্কুলারে বলা হয়েছে, রপ্তানি আয় কিংবা সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা দ্বারা ইডিএফ ঋণের দায় পরিশোধ করতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান অন্য ঋণ নিয়ে ইডিএফের দায় পরিশোধ করলে পরবর্তীতে তারা আর ইডিএফ ঋণ সুবিধা পাবে না।
রপ্তানি বাড়াতে স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় মাত্র ১ কোটি ৫০ ডলার নিয়ে ইডিএফ গঠন করা হয়। দেশের রপ্তানি আয় বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই তহবিলের আকারও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে এই তহবিলের আকার ৬ বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলার।
ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বাড়াতে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ, বিটিএমএ, নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক সংগঠনের সদস্যরা ইডিএফ থেকে ঋণ পেয়ে থাকেন।
বর্তমানে ইডিএফের আওতায় উৎপাদনের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ২ শতাংশ হারে সুদ আদায় করে থাকে। আদায় করা এই সুদের ১ শতাংশ পুনঃঅর্থায়নের সুদ বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে হয়। বাকি ১ শতাংশ পায় সংশ্নিষ্ট ব্যাংক।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।
আর এই আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
রপ্তানিতে এই উল্লম্ফনের পেছনে ইডিএফের অবদান রয়েছে জানিয়ে রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত নিট পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও আমরা পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি। এক্ষেত্রে ইডিএফ বেশ ভালো অবদান রেখেছে।’
বিটিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিসেম্বর পর্যন্ত ইডিএফ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো একটি কাজ করেছে। এতে রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি।’
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই দুই বছর পর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। মে মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।