বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ও সরকারি অফিস সময় কমানো বা হোম অফিসের ঘোষণা আসার পর পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হলো।
এক দিনে কোম্পানির দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে আড়াই শটিরও বেশি কোম্পানি। সব মিলিয়ে দর হারিয়েছে ৩৫২টি, বিপরীতে বেড়েছে কেবল ১৪টির দর। আর দর ধরে রাখতে পারে ১৬টি কোম্পানি।
গত অর্থবছরের মতোই অর্ধবার্ষিকীতে শেয়ার প্রতি সাড়ে ১২ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা গ্রামীণ ফোনও দর হারিয়েছে। বড় মূলধনি ও মৌলভিত্তির কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির দর কমেছে একদিনে যতটা কমা সম্ভব ততটাই।
৮৭ পয়েন্ট দরপতনে সূচকের অবস্থান নেমে গেছে প্রায় দুই মাস আগের অবস্থানে।
গত ২৫ মে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাধারণ সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ১৮৭ পয়েন্ট। আর সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবস সোমবার অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২১৬ পয়েন্টে।
দরপতনের মধ্যেও বেশিরভাগ শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। এর ফলে লেনদেন নেমে এসেছে একেবারে তলানিতে। কোনো রকমে পাঁচ শ কোটির ঘর অতিক্রম করেছে তা।
দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৫১৫ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
চলতি বছর এর চেয়ে কম লেনদেন হয়েছে হাতে গোনা কয়েক দিন।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন।
বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। ডলার সংকটের সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এক বছরে সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করার পর রিজার্ভ নেমে গেছে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমলেও এই মুহূর্তে লেনদেনের ভারসাম্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে। অর্থাৎ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে যে আয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে পণ্য কিনে আনতে।
জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা ঘোষণার দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতন হয়েছে
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে সারা দেশে ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে এলাকাভিত্তিক সূচি প্রকাশ শুরু করেছে। পাশাপাশি জরুরি সেবা ছাড়া অফিস সময় কমানো বা হোম অফিস করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা জানিয়েছে।
এসব সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে। এমনিতে অর্থনৈতিক চাপের কারণে নানা ধরনের গুজব ও গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী সুমন দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেট ধসের কারণ হলো রিটেইল বেসড মার্কেট। মানুষ প্যানিকড হয়ে শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে।’
প্যানিক সেলের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মানি মার্কেট হার্ট হয়েছে। সাপ্লাই কম। তার ওপর মুদ্রাস্ফীতি, রিজার্ভ কমে গেছে। রিজার্ভের যে অঙ্কের কথা বলা হচ্ছে, সেটা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিদ্যুতের ব্যাপারে সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নেয়নি। এই বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে প্যানিক সেল বাড়িয়েছে।’
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কি সেল প্রেসার বাড়িয়েছে, জানতে চাইলে সুমন দাস বলেন, ‘সব জায়গা থেকেই প্রেসার আসবে। মার্জিন লোনের ফোর্স সেল আসবে।’
জুলাই বা আগস্টে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু? উত্তরে ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের সিইও বলেন, ‘মানি মার্কেট যখন হার্ড হয় তখন অনেকটাই মুশকিল হয়। সবাই মানি মার্কেট কনসার্নড, ক্যাপিটাল মার্কেট নয়। বিনিয়োগকারীরা অনেকটা ওয়েট অ্যান্ড সি-তে চলে গেছেন। তাই বিনিয়োগ হবে কি হবে না তা বলা যাচ্ছে না।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
আগের দিনের মতোই দর বৃদ্ধির তালিকার বেশিরভাগই জাঙ্ক শেয়ারের দখলে। গতকালের মতো আজকেও ১০ শতাংশের কাছাকাছি দর বেড়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। তালিকার শীর্ষে থাকা ব্যাংকটির দর ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ বেড়ে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৬ টাকায়।
আগে ব্যাংকটির নাম ছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ পুঞ্জিভূত লোকসানের কারণে যদি কোনো বছর মুনাফাও করে, তারপরেও লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব নয়।
এর পরেই দর বেড়েছে জেড ক্যাটাগরিতে থাকা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির। ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ দর বেড়ে সর্বশেষ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭ টাকা ৩০ পয়সায়।
ধারাবাহিক লোকসানে থাকা কোম্পানিটিকে ২০১৭ সালে শেয়ার প্রতি ৬৯ টাকা ৫৫ পয়সা লোকসান গুনতে হয়েছিল। এর পর আর কোনো তথ্য নেই ডিএসইর ওয়েবসাইটে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর বেড়েছে মিথুন নিটিংয়ের। গতকাল দর বৃদ্ধির তালিকায় সবার ওপরে ছিল কোম্পানিটি। কোম্পানিটি উৎপাদনে নেই ২০১৭ সাল থেকে। সম্প্রতি নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে কোম্পানিটি।
আজ কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গতকাল ১৭ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস আজ দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকা ৩০ পয়সায়।
তালিকার চতুর্থ স্থানে থাকা সাভার রিফ্যাক্টরিজ লিমিটেডের দর বেড়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ বা ৬ টাকা ৫০ পয়সায়। গতকাল শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ২৩৯ টাকা ৭০ পয়সা, সেটা আজকে হয়েছে ২৪৬ টাকা ২০ পয়সা।
পঞ্চম স্থানে থাকা ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ২ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ ১০০ টাকা ২০ পয়সায় হাতবদল হয়েছে। ২০ কোটির পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছরই ১০ শতাংশের ওপরে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের।
এ ছাড়া দর বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে লিবরা ইনফিউশন, ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, এইচ আর টেক্সটাইল এবং ট্রাস্ট ব্যাংক।
দর পতনের শীর্ষ ১০
দরপতনের শীর্ষে রয়েছে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। শেয়ারটির দর সর্বোচ সীমায় অর্থাৎ ২ শতাংশ বা ১ টাকা কমেছে।
৮ জুন লেনদেন শুরুর পর টানা বাড়তে থাকে কোম্পানিটির। ৪ জুলাইয়ে দর দাঁড়ায় ৫৭ টাকা ৩০ পয়সায়। সেখান থেকে কয়েকদিন দর কমে আজ সর্বশেষ ৪৯ টাকায় লেনদেন হয়।
কুইন সাউথ টেক্সটাইল লুজার তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। শেয়ারটির দর ৫০ পয়সা বা ২ শতাংশ কমেছে।
এই তালিকার সব কোম্পানির দর কমেছে দুই শতাংশের কাছাকাছি। অন্য কোম্পানিগুলো হলো রিজেন্ট টেক্সটাইল, স্যালভো কেমিক্যাল, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, কে অ্যান্ড কিউ, রহিমা ফুড, বিডি ল্যাম্পস, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ও ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
একই তালিকায় ছিল আড়াই শরও বেশি কোম্পানি।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ৮ দশমিক ০৬ পয়েন্ট সূচক কমেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর কারণে। কোম্পানিটির দর কমেছে এক দশমিক ৮০ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট কমিয়েছে রবি। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ।
ওয়ালটন হাইটেকের দর শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ দর কমার কারণে সূচক কমেছে ৪ দশমিক ২৯ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ইউনাইটেড পাওয়ার, বেক্সিমকো, স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক ও বার্জার পেইন্টসের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০ কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৩৪ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট।
সূচক বাড়াল যারা
ব্যাপক দর পতনের কারণে কোনো কোম্পানি এককভাবে এক পয়েন্টও সূচকে যোগ করতে পারেনি।
সবচেয়ে বেশি শূন্য দশমিক ৫১ পয়েন্ট বাড়িয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। কোম্পানিটির দর শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ দর বেড়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার দর শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩৬ পয়েন্ট।
ইউনিলিভার সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ২৮ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এ ছাড়া ট্রাস্ট ব্যাংক, আল-আরব ব্যাংক, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ওরিয়ন ইনফিউশন, বাটা সু, লিবরা ইনফিউশন ও মিথুন নিটিং সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট।