কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর আবার ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে।
এই বাজার থেকে এক ডলার কিনতে রোববার দুপুরে ১০০ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১০০ টাকা ৩০ পয়সা লেগেছে। এর আগে গত ১৭ মে খোলাবাজারে ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর। ১০৪ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল।
দুই-তিন দিন ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হওয়ার পর অবশ্য কমে আসে। গত দুই মাস ৯৭ থেকে ৯৯ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, খোলাবাজারে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সে কারণেই ডলারের দাম ফের ১০০ টাকার ওপরে উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ডলার পাচ্ছি না। আজ আমি এক ডলারও কিনতে পারিনি। আগে কিছু ডলার কেনা ছিল, সেগুলোই বিক্রি করেছি আজ।’
খোলাবাজারের পাশাপাশি ব্যাংকেও ডলারের দর বাড়ছে। গত এক বছরে আন্তব্যাংকে প্রতি ডলারে ৯ টাকা ১৫ পয়সা দর বেড়ে এখন ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে দর ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলারও বেশি দামে বিক্রি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক রোববার ৯৬ টাকা ৫০ পয়সায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৮ টাকায়। প্রাইম ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৭ টাকা দরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত দেড় মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত বছরের ১৩ জুলাই প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়েছিল। দেড় মাস আগে ৩০ মে লেগেছিল ৮৯ টাকা।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে আমেরিকান ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। এর পরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হচ্ছে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। বাজার ‘স্থিতিশীল’ রাখতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজারে ডলারের চাহিদার জোগান দিতে ঈদের ছুটির পর প্রথম কর্মদিবস গত মঙ্গলবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার দরে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায় ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। বুধবার বিক্রি করা হয়েছে ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ঈদের ছুটির আগে কয়েক দিনে বিক্রি করা হয়েছিল ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৩ দিনে (১ থেকে ১৩ জুলাই) ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার এবং চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার ব্যাংকগুলোর কাছে আন্তব্যাংক দরে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। তবে মোট কী পরিমাণ বিক্রি করেছে, তা জানা যায়নি।
এর ফলে গত ১২ জুলাই বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়।
অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে আমেরিকান ডলারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এর পরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত বছরের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। সে সময় ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।
গত মে মাসে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
আর আমদানির ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।