ঈদের পরে তিন কর্মদিবসেই পুঁজিবাজারে পতনের পর সেটি আরও দীর্ঘায়িত হলো। নতুন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববারও দরপতন দেখল বিনিয়োগকারীরা। তবে এর মধ্যে চাঙা ছিল জাঙ্ক শেয়ার নামে পরিচিত দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার।
উৎপাদনে নেই, দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছে, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে না এবং স্বল্পমূলধনি কোম্পানির আধিপত্য ছিল লেনদেনে। দর বৃদ্ধির তালিকার প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে এসব কোম্পানি।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে আটটিই জেড ক্যাটাগরির শেয়ার। কয়েকটির লোকসান আকাশচুম্বি। এক দশক ধরে লভ্যাংশ দিতে পারে না-এমন কোম্পানি বেশ কয়েকটি।
সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পাওয়া মিথুন নিটিং উৎপাদনে নেই ২০১৭ সাল থেকে। কোম্পানিটি সম্প্রতি নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে।
তালিকায় রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, যেটি আগে ছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ পুঞ্জিভূত লোকসানের কারণে যদি কোনো বছর মুনাফাও করে, তারপরেও লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব নয়।
এমন দুটি কোম্পানির দর বেড়েছে ১০ শতাংশ করে।
গত দুই বছর শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা করে লভ্যাংশ দেয়া স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ২ টাকা ২০ পয়সা করে লোকসান দিয়েছে। এই কোম্পানির দর বেড়েছে ৯.৯৩ শতাংশ।
তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে কখনও লভ্যাংশ দিতে না পারা মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক ও মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজের দর প্রতি বছরই লভ্যাংশ ঘোষণার আগে আগে লাফ দেয়।
এবারও তাই হয়েছে। এই দুটি কোম্পানির দর গত এক মাস ধরেই ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আজ বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব, ততটাই।
মেঘনা কনডেন্সড মিল্পেক তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত এই কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ৫ টাকা ৩৪ পয়সা। শেয়ার প্রতি কোনো সম্পদ নেই, উল্টো দায় ৭৩ টাকা ১৫ পয়সা।
এমন কোম্পানির দর দাঁড়িয়েছে ৩৮ টাকা ৮০ পয়সা। এক দিনে বাড়ল ৯.৯১ শতাংশ।
মেঘটা পেটি ইন্ডাস্ট্রিজের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি লোকসান ১৮ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি দায় ৪ টাকা ৭৩ পয়সা।
এমন কোম্পানির দর দাঁড়িয়েছে ৪২ টাকা ১০ পয়সা। এক দিনে বাড়ল ৯.৯২ শতাংশ।
ষষ্ঠ স্থানে থাকা গ্লোবাল হেভি কেমিক্যালস চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি লোকসান দিয়েছে ৬৮ পয়সা। গত তিন বছর কখনও শেয়ার প্রতি এক টাকাও আয় করতে পারেনি।
এই কোম্পানির দর ৯.৫১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৮ টাকা।
২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি ৯৪ টাকা ২৭ পয়সা লোকসান দেয়ার পর বিআইএফসি আর কখনও আর্থিক হিসাবও প্রকাশ করেনি। এই কোম্পানির শেয়ার দর এক দিনে বেড়েছে ৮.০৬ শতাংশ। শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৬.৭ টাকা।
২০২১ সালে শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা লভ্যাংশ দেয়া মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ চলতি অর্থবছরে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ১ টাকা ২১ পয়সা লোকসান দেয়ায় বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
৮ শতাংশ বেড়ে এই কোম্পানির শেয়ারদর ৩৫ টাকা থেকে হয়েছে ৩৭ টাকা ৮০ পয়সা।
লোকসানে ডুবে যাওয়া তাল্লু স্পিনিং চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ১ টাকা ৪৭ পয়সা। ২০১৫ সালের পর থেকে লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৭.৯২ শতাংশ।
তালিকায় দশম স্থানে থাকা ইনটেক অনলাইনের আর্থিক ভিত্তি ভালা নয় কোনোভাবেই। ২০১৯ সালে কোনো লভ্যাংশ না দেয়া কোম্পানিটি পরের বছর শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিয়ে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ফেরে।
চলতি বছর তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ১৯ পয়সা আয় করা কোম্পানিটির দর সম্প্রতি বাড়ছে। ৭.৮৪ শতাংশ বেড়ে শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৩৪ টাকা ৪০ পয়সা।
কেবল শীর্ষ ১০ নয়, শীর্ষ বিশেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাঙ্ক শেয়ারের দাম বাড়ার কারণ বিনিয়োগকারীরা সেগুলোতে ঝুঁকেছেন। কোনো কিছু হিসাব না করেই তারা হুজুগে কিনছেন। যখন যেই হুজুগ চলে তখন সেই দিকে ছোটেন তারা। অন্য কোনো কারণ নেই।’
সব মিলিয়ে যতগুলো শেয়ারের দাম বেড়েছে তার চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে। ৯৯টি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২৩৬টির। আগের দামেই লেনদেন হয়েছে ৪৭টি কোম্পানির শেয়ার।
দিনের শুরু থেকেই নিম্নমুখী প্রবণতায় লেনদেন হয়েছে। দিন শেষে ব্যাপক দর পতনে আগের দিনের চেয়ে ২০ পয়েন্ট হ্রাস পেয়ে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৬ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে।
লেনদেন তলানিতেই থেকে গেছে। আগের কর্মদিবস বৃহস্পতিবারে হাতবদল হয়েছিল ৫৮০ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকার। ১২ কোটি ৮৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বেড়ে দিনভর হাতবদল হয়েছে ৫৯৩ কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার টাকার।
লেনদেনের বিষয়ে ক্যাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী রাজেশ সাহা বলেন, ‘ঈদের পরে দ্রুতই বাজার ভালো হয়, এমনটা অতীতেও দেখা যায়নি। আমার মতে, আরেকটু সময় লাগবে। আগস্টের দিকে হয়তো কিছু ফান্ড ইনজেক্ট হতে পারে।’
একই কথা বললেন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেনও। তার বক্তব্য এমন: ‘নতুন অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো ফান্ডের ইনজেকশন দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো অনেকেই গোছাচ্ছেন। অর্থবছর শুরু হয়েছে মাত্র, আরেকটু সময় গেলে হয়তো নতুন অর্থ ঢুকতে দেখা যাবে।’