সরকারের সঙ্গে আইএমএফ সফররত প্রতিনিধি দলের আসন্ন বৈঠকে রাজস্ব পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইবে প্রতিনিধি দল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কথা বলবে তারা।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ ও ভর্তুকিতে বিশাল বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে সংস্থাটি। অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকারের চলমান আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। আইএমএফ স্টাফ মিশন নামে পাঁচ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল এসেছে গত বৃহস্পতিবার।
সফরকালে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবে।
সোমবার থেকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করবে প্রতিনিধি দলটি। বাংলাদেশে এক সপ্তাহ অবস্থান করবে তারা। এর আগে গত মার্চে ঢাকায় এসেছিল প্রতিনিধি দলটি।
সূত্র জানায়, এবারের বৈঠকে চলামান সংস্কার কর্মসূচির অগ্রগতি জানতে চাইবে আইএমএফ। কিন্তু ঋণ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের পর একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে আইএমএফ স্টাফ মিশন। সফর শেষে প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে।
সূত্র বলেছে, এই মিশনের সফর শেষে দুই মাস পর আরেকটি দল আসবে। সেই বৈঠকে সংস্কার কর্মসূচি মূল্যায়ণ করে বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে আইএমএফ।
দরকষাকষি চূড়ান্ত হলে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হবে। এর পরই ঋণ মিলবে।
এবারের বৈঠকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে রাজস্ব পরিস্থিতি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মূলত ঋণ সংকটই দায়ী– এ কথা বাংলাদেশ সরকারকে সর্তক করবে আইএমএফ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো। বিদেশি ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে আরও জোর দেয়ার পরামর্শ দেবে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা হবে।
আইএমএফ মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হলে অব্যশই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
অর্থমন্ত্রণায়ের সঙ্গে বৈঠকে মূলত বাজেট ঘাটতি ও ভর্তুকি বিষয় আলোচনা প্রাধান্য পাবে। এবারের বাজেটে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এ যাবত কালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি একটি অনুৎপাদনশীল খাত। বেশি ভর্তুকি দেয়ার অর্থ হচ্ছে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ব্যহত হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়।
বর্তমানে ভর্তুকি খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আড়াই শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে চলতি বাজেটে ভর্তিকিতে বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়েছে। তবে বাজেট ঘাটতি যাতে না বাড়ে সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার পরামর্শ দেবে আইএমএফ। অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, আইএমএফের কথা সবসময় শোনা সম্ভব নয়। বাস্তবতা বিবেচনা করে এসব বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফ স্টাফ মিশন বাজেটের আগে একবার এসেছিল। এখন আবার এসেছে। এবারের বৈঠকের মূল এজেন্ডা হচ্ছে রাজস্ব। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কী ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইবে প্রতিনিধি দল। চলতি বাজেটে ভর্তুকিতে বেশি বরাদ্দ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তার ব্যাখ্যা দেব। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার কথা বলবে। তবে এটাও ঠিক, ভর্তুকির চাপ কমাতে হলে এটির দাম বাড়াতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বৈঠকে আমরা কোনো ঋণ সহায়তা চাইব না। আরও আলোচনা হবে। তারপর অনুরোধ করা হবে।’
কত ঋণ চাওয়া হবে– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঋণের অঙ্ক এখনও ঠিক হয়নি।’
জানা যায়, এক দশক পর আইএমএফের কাছে ঋণ চাইবে বাংলাদেশ। ঋণ প্রদানে সংস্থাটিরও আগ্রহ আছে। তবে তারা ঋণ দেবে বাজেট সহায়তা হিসেবে এবং তা হবে দরকষাকষি ও শর্তসাপেক্ষ।
বাংলাদেশ এর আগে আইএমএফ থেকে চারবার ঋণ নেয়। প্রথমবার ঋণ নেয়া হয় ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে। এরপর ২০০৩-২০০৪, ২০১১-১২ এবং সর্বশেষ ২০২০-২১ সালে সংস্থাটি থেকে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। তবে কোনোবারই ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়ায়নি। এবার আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ চাওয়া হবে বলে জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, তিনটি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে ঋণ দেয় আইএমএফ। এ গুলো হচ্ছে: বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার জন্য গঠিত সহনশীলতা ও টেকসই তহবিল বা (আরএসএফ)। এবার তিনটি তহবিল থেকেই ঋণ সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো সহজ শর্তে ও কম সুদে বাংলাদেশকে ঋণ দেয় আইএমএফ।