বিশ্বজুড়ে খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন একটি কার্যকর ও অর্থসাশ্রয়ী পদক্ষেপ। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের কোনো একটি নির্দিষ্ট খাদ্যে বাধ্যতামূলকভাবে এ ভিটামিন প্রয়োগ করে থাকে।
গুয়াতেমালা, চিলি ও যুক্তরাজ্যে ভিটামিন ‘এ’ মেশানো হয় দুধে। ডেনমার্কে মারজারিন নামের খাদ্যে সংযোজন করা হয় এ ভিটামিন। একইভাবে বলিভিয়ায় ভিটামিনটি দেয়া হয় ভেজিটেবল অয়েলে।
বিশ্বের অনেক দেশ স্থানীয়ভাবে যার যার সুবিধা অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনো একটি খাদ্যপণ্যে জাতীয়ভাবে সবার জন্য তা প্রয়োগ করা ছিল কঠিন কাজ। কোন বিশেষ খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা হবে, তা নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। কারণ ক্রয়ক্ষমতা ও সামর্থ্য বিবেচনায় সব খাদ্য দেশের সব জনগোষ্ঠীর জন্য এখনও সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ গবেষণা ও জরিপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোজ্যতেলকেই নির্দিষ্ট করা হয়।
শিল্প ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের যৌথ গবেষণা ও জরিপে উঠে এসেছে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলই একমাত্র খাদ্য, যা ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষ খেয়ে থাকে। এটি ছাড়া রান্না হয় না।
সব তেলে ভিটামিন ‘এ’ মেশানো সম্ভব নয়। জরিপে দেখা যায়, দেশে অনেক ধরনের ভোজ্যতেল থাকলেও ৯৯ শতাংশ মানুষ সয়াবিন ও পাম অয়েল ব্যবহার করছে। যারা অন্যান্য তেল খায়, তারাও হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে সয়াবিন ও পাম অয়েলের তৈরি খাবারই খাচ্ছে। সেই অর্থে শতভাগ মানুষ খাচ্ছে সয়াবিন ও পাম অয়েল।
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে এ দুটি তেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ হয়ে আসছে।
পাইলটিং শেষে ২০১৩ সাল থেকে দেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি, পরিশোধন, উৎপাদন, মোড়কজাত ও বাজারজাত সঠিক মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ মেশানো বাধ্যতামূলক করা হয়। একই সঙ্গে “ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন-২০১৩” প্রণয়ন করা হয়। এটি প্রতিপালন না হওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
এই আইন বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনটিকে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’-এর তফসিলভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া এ আইন অনুযায়ী রিফাইনারিগুলো সঠিক মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ করছে কি না এবং আমদানিকারক ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল আমদানি করছে কি না, তা কঠোরভাবে নিয়মিত মনিটর করতে বিএসটিআইয়ের প্রতি নির্দেশ রয়েছে।
বাংলাদেশে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ডব্লিউএইচও, এফএও এবং ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সের মাধ্যমে করা গবেষণা অনুযায়ী ১৫ থেকে ৩০ পিপিএম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল গ্রহণ করলে সুস্থ মানুষের যেমন শারীরিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই, তেমনি এ নির্ধারিত মাত্রা শরীরে ঘাটতিজনিত সমস্যাও দূর করবে।
কার্যক্রম শুরু হওয়ার এক যুগেও দেশে এ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানি পর্যায়ে এই নিয়ম সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের একটি আদালত সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয়ায় সয়াবিন ও পাম অয়েলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ বা মেশানোর বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই নগরীর উত্তর পতেঙ্গায় অবস্থিত ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডে বিএসটিআই পরিচালিত অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত ফর্টিফায়েড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফায়েড পাম অয়েলের নমুনা পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি।
শুধুই কি সিটি
শুধু সিটি নয়, দেশে ভোজ্যতেলের বাজারজাতকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও রয়েছে কম-বেশি অভিন্ন অভিযোগ। তার প্রমাণ মেলে ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) পরিচালিত জরিপে।
ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪৭ শতাংশ খোলা এবং ১৩ শতাংশ বোতলজাতকৃত ভোজ্যতেলে এখনও ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ বোতলজাত ও ৫৩ শতাংশ খোলা তেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ সম্ভব হয়েছে।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, সরকারের গৃহীত নানা উদ্যোগের ফলে বর্তমানে দেশের প্যাকেটজাত ভোজ্যতেলের ৯৫ শতাংশ এবং ড্রামজাত ভোজ্যতেলের ৪১ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণের আওতায় এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোজ্যতেলে এখনও ভিটামিন ‘এ’ শতভাগ সমৃদ্ধকরণ সম্ভব না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা। দেশের বেশির ভাগ ভোক্তাই কম দামের খোলা তেলে অভ্যস্ত। তা ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোও বেশি মুনাফা অর্জনে তাদের খাদ্যপণ্যে কমদামে খোলা তেল বেশি ব্যবহার করে। ফলে কোম্পানিগুলো বাজারে যে পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ করে তার ৬৫ শতাংশই খোলা। মাত্র ৩৫ শতাংশ বাজারজাত হচ্ছে বোতলজাত আকারে।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, চলতি বছরের ১৬ মার্চের পর কাউকে আর ছাড় দেয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘আমরা এখনও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পোদ্যোক্তাদের সচেতন করছি, সমস্যাগুলো তুলে ধরছি, কিন্তু ২০২২ সালের ১৬ মার্চের পর থেকে কোনো ছাড় নয়। সবাইকেই বাধ্যতামূলক প্যাকেজিংয়ে যেতে হবে।’
মার্চ পেরিয়ে জুলাই চলে যাচ্ছে। বাজারে এখনও খোলা তেল মিলছে। একই সঙ্গে বোতলজাত ও খোলা শতভাগ ভোজ্যতেলে এখনও ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ করা সম্ভব হয়নি।
কবে থেকে দেশে খোলা সয়াবিন তেল বাজারজাত বন্ধ হচ্ছে জানতে চাইলে দেশে ভোজ্যতেলের বড় উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খোলা তেল বাজারে স্থায়ীভাবে সরবরাহ বন্ধ করতে উৎপাদকরা ২০২২ সালের ডিসেম্বরকে লক্ষ্য ধরে এগোচ্ছে।’
এ প্রতিষ্ঠানের (সিটি গ্রুপ) উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, ‘এখন সিটি গ্রুপ ৪০ শতাংশ তেল মোড়কজাত করছে। বাকি ৬০ শতাংশ চলতি বছরের মধ্যে করে ফেলব।’
ভিটামিন ‘এ’ কী এবং কেন দরকার
ভিটামিন ‘এ’ হলো খাবারের মধ্যে থাকা জৈব অণু। এর রাসায়নিক নাম ‘রেটিনাল।’ মানবদেহে ভিটামিন ‘এ’ সংমিশ্রণ হলে রেটিনোয়িক অ্যাসিড তৈরি করে, যা খাদ্যের খুব প্রয়োজনীয় উপাদান। ভিটামিন ‘এ’ মূলত ক্যারোটিন থেকে তৈরি হয়, যার উৎস দুটি। এর একটি উদ্ভিদজাত; অন্যটি প্রাণিজাত।
পুষ্টি বিশারদরা মনে করেন, শরীরে ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োজন অনুযায়ী থাকা দরকার। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর শরীরে কমপক্ষে ৭০০ মাইক্রোগ্রাম এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে দিনে কমপক্ষে ৯০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ থাকা দরকার। নারীর খাবারে দৈনিক সর্বাধিক সর্বোচ্চ ৩ হাজার মাইক্রোগ্রাম ও পুরুষের ৩ হাজার মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ থাকা দরকার।
ভিটামিন ‘এ’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি চোখের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। শরীরের বিকাশেও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেহের বাহ্যিক আবরণের কোষ, ত্বক, দাঁত ও অস্থি গঠনের জন্য ভিটামিন ‘এ’ জরুরি। তা ছাড়া ভিটামিন ‘এ’ নানা রকমের সংক্রামক রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। এটি লৌহের ঘাটতি দূর করে। ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় না।
ভিটামিন ‘এ’ বার্ধক্য রোধ করতেও সহায়ক। এটি পরিমিত খেলে ত্বকের শুষ্কতা বা বলিরেখা থাকে না। এ ছাড়া ভিটামিন ‘এ’ টিউমার ও ক্যানসার থেকে রক্ষা করে; লিভার ভালো রাখে। নাকের শ্লেষ্মা, ঝিল্লিকেও সুস্থ রাখে।
বিষয়টি জাতীয় স্বাস্থ্যের
আর্থসামাজিক সব দিক থেকে এগিয়েছে দেশ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর ভর করে বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে, তবে এক যুগ আগেও বাংলাদেশের এই উন্নয়ন চেহারার দেখা মিলত না। তখন ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত রোগ বাংলাদেশে একটি জাতীয় সমস্যা ছিল। প্রায় ১৮ থেকে ২২ শতাংশ শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ রাতকানা, জেরোফেলমিয়া, জিরোসিসসহ বিভিন্ন চক্ষু রোগে আক্রান্ত হতো। অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছিল এবং ত্বকের পিগমেন্টেশন পরিবর্তনসহ শারীরিক বৃদ্ধির ঘাটতি ছিল।
বাংলাদেশে ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়্যান্ট স্ট্যাটাস সার্ভে ২০১১-১২ অনুযায়ী, তখন ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতায় ভুগত দেশের ২০.৫ শতাংশ স্কুলপূর্ব শিশু ও ২০.৯ শতাংশ স্কুলে যাওয়া শিশু। এ ছাড়া ৩৮.১ শতাংশ বস্তিবাসী শিশু ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতার শিকার হতো।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০০৭ অনুযায়ী, ওই সময় দেশে শিশু মৃত্যুহার ছিল হাজারে ৫২। পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ৬৫, নবজাতকের মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ৩৭ এবং জন্মদানের সময় মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৩২০।
নিউট্রিশনাল সার্ভেইল্যান্স প্রজেক্টের ২০০৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ০.০৪ শতাংশ এবং মায়েদের ০.৩৩ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতির কারণে রাতকানা রোগে ভুগত।
আইসিডিডিআরবির ২০১৩ সালের তথ্য বলেছে, প্রাক-বিদ্যালয় বয়সের শিশুদের মধ্যে রেটিনলের সিরাম মাত্রার মাধ্যমে পরিমেয় ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতির সাবক্লিনিক্যাল ব্যাপকতা ছিল ২০.৫ শতাংশ। বস্তিতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে এ ব্যাপকতা ছিল ৩৮.১ শতাংশ। শিশু ও নারীদের মধ্যে ছিল ২০.৯ শতাংশ ও ৫.৪ শতাংশ। বস্তিতে বসবাসকারী বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সীদের ব্যাপকতা ছিল ২৭.১ শতাংশ।
এমন বাস্তবতাকে বিবেচ্য রেখে নারী ও শিশুদের মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো এবং আগামীর বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবান রেখে কর্মউদ্দীপনা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ যৌথভাবে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সংমিশ্রণ ধারণাটি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন শুরু করে।
এর মাধ্যমে শুধু প্রথম পাইলটিং প্রকল্পেই পাঁচ বছরের কমবয়সী ১ কোটি ৬১ লাখ শিশু, ৬-১৯ বছর বয়সী ৪ কোটি ২০ লাখ শিশু-কিশোর এবং ৩ কোটি ২১ লাখ নারীকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়।