পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগ স্থাপনের পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণের জীবনমানকে এগিয়ে নেবে তা নয়, এই সেতু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরো দেশের মানুষের জীবনকে এগিয়ে নেবে আরেক ধাপ।
কিন্তু এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দক্ষিণাঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়ন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন গ্যাস সরবরাহ। দেশীয় শিল্পেরাদ্যোক্তারা বলেছেন, দ্রুত বিনিয়োগের জন্য গ্যাস সরবরাহের বিকল্প নেই। তা না হলে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না।
গত ২৫ জুন যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় পদ্মা সেতু।
নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হওয়া এই সেতুর রাজনৈতিক গুরুত্ব যতটুকু, তার চেয়ে বেশি এটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব। পদ্মা সেতুর ফলে শুধু যে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বাড়বে তা নয়, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এটি এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সুফল ভোগ করবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে এ দেশের সড়ক ও রেল সংযোগ স্থাপনের সুযোগ হলো। ফলে এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে অপরিসীম সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালুর ফলে কী ধরনের শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে এবং শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী- তা নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে দেশের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে। সবাই একবাক্যে সম্ভাবনার কথা বললেও বাধা হিসেবে গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি উল্লেখ করেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও পর্যটন শিল্পের কথাও জানান তারা।
পাশাপাশি পাট, টেক্সটাইল, স্পিনিং, হালকা প্রকৌশল ও কেমিক্যাল শিল্পের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তারা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ আছে কৃষিজাত পণ্যে। পরিবহনে সময় কমে যাওয়ায় পণ্যের বাজারজাত সহজ হবে। ফলে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবে।
যোগাযোগ করা হলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তার মতে, টেক্সটাইল, স্পিনিংয়ের মতো ভারী শিল্প গ্যাসনির্ভর। এসব শিল্প শ্রমঘন। তাতে অসুবিধা নেই। কারণ সহজেই শ্রমিক পাওয়া যাবে। জমিরও কোনো সমস্যা নেই। অসুবিধা একটাই- গ্যাস সংকট। এটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে শিল্পায়ন হবে না।
শীর্ষ এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, ‘নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে ওই অঞ্চলে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এগুলোর অবকাঠামো দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’
মোংলাকে আধুনিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি আরও বলেন, ‘এই বন্দর প্রধানত বাল্কনির্ভর। কনটেইনার পরিবহন কম হয়। বন্দরের অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে, যাতে কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ আসতে উৎসাহিত হয়। এ ছাড়া নাব্যতার সমস্যা আছে। নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে।’
পদ্মা সেতুর কারণে শুধু শিল্প খাতেই নতুন নতুন বিনিয়োগ হবে না, সুফল মিলবে কৃষি খাতেও। পর্যটন এলাকাও গড়ে উঠবে বলে জানান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই শীর্ষ নেতা।
পুনরুজ্জীবিত হবে পাটশিল্প
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাট কিনে খুলনায় আনা হয়। এই পাট মোংলা বন্দর হয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাটকে কেন্দ্র করে খুলনায় বেশ কয়েকটি পাটকল কারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু দুর্নীতি, অদক্ষতা, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে অনেক পাটকল রুগ্ণ হয়ে পড়েছে।
পাট কিনে আনার সময় পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হয়। আবার পাটকলে উৎপাদিত পণ্য রাজধানীতে নেয়া হয়। এতে যে সময়ের অপচয় হতো, তার আর্থিক মূল্য অনেক বেশি।
মীর নাসির মনে করেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে ওই অঞ্চলে পাটশিল্পে পুনর্জাগরণের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ সহজ হবে। কৃষি ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে। ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কৃষিতে জোয়ারের সম্ভাবনা
দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্যভান্ডার। কিন্তু এ সুযোগ এত দিন পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এখন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে সেখানে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। ধানের উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতগুলোর বিস্তার ঘটবে। ফলে চাল উৎপাদন বাড়বে।
বরিশাল ও পটুয়াখালীতে প্রচুর তরমুজের চাষ হয়। কিন্তু ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধাসহ বিপণন সমস্যার কারণে কৃষক তরমুজ চাষে তেমন লাভবান হন না। এখন এ সমস্যা দূর হবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত তরমুজ পাঠানো সম্ভব হবে। ফলে কৃষকদের তরমুজ বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে।
প্রচুর ফুলের চাষ হয় যশোরে। এখানকার ফুল রপ্তানি হয় বিদেশেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষিপণ্য রাজধানীতে নেয়া হয়। পদ্মা সেতুর ফলে এসব কৃষিপণ্যের চাষ উৎসাহিত হবে ব্যাপকভাবে।
পর্যটনে নতুন আশার আলো
ব্যবসায়ীরা জানান, পদ্মা সেতুর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের পাশাপাশি সুন্দরবন ও সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্যাস নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন আছি। দক্ষিণাঞ্চলে দ্রুত বিনিয়োগ চাইলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।’
তার মতে, 'এখন আমাদের শিল্পগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। পদ্মা সেতুর ফলে অনেক উদ্যোক্তা দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
পদ্মা সেতু নিজেই একটি দর্শনীয় স্থান- এ কথা জানিয়ে পোশাক খাতের শীর্ষ এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘একে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট গড়ে ওঠার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সময় কমে যাওয়ায় পর্যটকরা এখন সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার দিকে ঝুকঁছে। বাড়ছে সুন্দরবনে দর্শনার্থী।’
সব মিলিয়ে দেশের পর্যটনশিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।