যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালির পাশাপাশি জাপান, ভারত ও পোল্যান্ডসহ অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারেও পণ্য রপ্তানিতে চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পাশের দেশ ভারতে রপ্তানি প্রথমবারের মতো ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। পোল্যান্ডে ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। জাপানে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
মধ্যপাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং ব্রাজিলের মতো অপ্রচলিত দেশেও রপ্তানিতে আশা জাগানিয়া সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
আর এসব কারণেই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন রপ্তানিকারকরা।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা মহামারি, যুদ্ধসহ নানা সংকটের মধ্যেও গত অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে অবাক করার মতো সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৮২ শতাংশই এসেছে আমাদের তৈরি পোশাক থেকে। আশা করছি, আগামী দিনগুলোতেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি বাজার বহুমুখীকরণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন বাজার তৈরি ও আমাদের মূল বাজারগুলোতে কিভাবে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারি সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। বিগত দশকে বাজার সম্প্রসারণে আমাদের সফলতাও অনেক। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা সাড়ে ৭ গুণ বেড়ে ৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।’
‘এশিয়ার দেশ জাপান, যা কি না বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক আমদানিকারক দেশ, সেখানে আমাদের পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছর ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ইস্টার্ন ইউরোপের আরেকটি দেশ পোল্যান্ডে আমাদের রপ্তানি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করছে। আমরা যদি সামগ্রিকভাবে অপ্রচলিত বাজারগুলোর ব্যাপারে আরও মনোযোগী হই, তাহলে আমাদের সামনে বিপুল সম্ভাবনার জায়গা রয়েছে।’
‘২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির যে স্বপ্ন আমরা বুনেছি, তা অবশ্যই পূরণ হবে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পালে হাওয়া লেগেছে। যুদ্ধের মধ্যেও তা অব্যাহত ছিল। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪.৩৮ শতাংশ। এর মধ্যে তিনটি প্রধান বাজার থেকেই এসেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলো থেকে এসেছে ২৩.২৩ বিলিয়ন ডলার বা ৪৪.৬১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১০.৪১ বিলিয়ন ডলার বা ২০ শতাংশ। কানাডা থেকে ১.৫২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩ শতাংশ)।
অপ্রচলিত দেশগুলোর মধ্যে চমক দেখিয়েছে পোল্যান্ড, ভারত ও জাপান। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পোল্যান্ডে মোট ২.১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৪.১১ শতাংশ। দেশটিতে প্রথমবারের মতো ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ৪২.২৭ শতাংশ। এই আয়ের মধ্যে ১.২৬ বিলিয়ন ডলারই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। হোম টেক্সটাইল থেকে এসেছে ৪ কোটি ডলার। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে এসেছে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। আর পাদুকা রপ্তানি থেকে এসেছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
২০২১-২০২২ অর্থবছরের ভারতে ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৫৫.৬২ শতাংশ বেশি। মোট রপ্তানির ৪ শতাংশের মতো এসেছে পাশের এই দেশটি থেকে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে ভারত এখন বাংলাদেশের সপ্তম রপ্তানি বাজারের তালিকায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ ১০ বাজারের একটি এখন ভারত।
অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরেও বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ রপ্তানি বাজারের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল না। আগের বছরগুলোতে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪ থেকে ১৫তম স্থানে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র তিনটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত তিন বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
তবে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়েই সেই রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১০৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। সাত মাসে তা বেড়ে ১২১ কোটি ২৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তা আরও বেড়ে ১৩৬ কোটি ১০ ডলারে ওঠে। এভাবে প্রতি মাসেই বাড়তে বাড়তে ২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন, যা ছিল এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে এ আয় বেশি ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে মোট রপ্তানির মধ্যে ৪০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। নিট পোশাক রপ্তাানি হয়েছে ৩১ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলারের।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। ১০ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ডলার এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে। কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে এসেছে প্রায় ৪ কোটি ডলার। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ৩ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উল্লেখযোগ্য গন্তব্যস্থল হলো জাপান। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাপানে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা, যা মোট রপ্তানি আয়ের ২.৬০ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে আয় বেড়েছে ১৪.৩৮ শতাংশ।
এই আয়ের মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৫৯ কোটি ডলার। ওভেন থেকে এসেছে ৫০ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ লাখ ডলার। হোম টেক্সটাইল থেকে এসেছে ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চামড়াজাত পণ্য থেকে এসেছে ৯ কোটি ৩৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এছাড়া পাদুকা থেকে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার এবং ক্রাস্টেসিয়ানস রপ্তানি থেকে ১ কোটি ৩১ লাখ ডলার এসেছে।
তবে বিশ্বের অন্যতম বড় বাজার চীনে রপ্তানি বেড়েছে খুবই সামান্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটিতে ৬৮ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। গত অর্থবছরে হয়েছে ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৪১ শতাংশ।
যুদ্ধের ধাক্কায় রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ৪.০৬ শতাংশ কমেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এই বাজারে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) হয়েছিল ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল; আশা করা হচ্ছিল, এবার দেশটিতে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেটা আর হয়নি।
অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে গত অর্থবছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৮৬ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫৩ কোটি ডলার, হংকংয়ে ১৪ কোটি ডলার, ব্রাজিলে ১১ কোটি ডলার, সৌদি আরবে ২৯ কোটি ডলার, মেক্সিকোতে ২৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, মালয়েশিয়ায় ৩৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুরে ১২ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ডলার এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।