বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কমছে আমদানি, ফিরছে স্বস্তি

  •    
  • ৮ জুলাই, ২০২২ ১০:০৭

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমদানি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারাবাহিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে বেশ কিছু পণ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। সেসবের ফলেই এখন আমদানি কমছে।’

দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে তা কমতে শুরু করেছে।

সর্বশেষ মে মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।

এর আগের ছয় মাসের প্রতিটিতে আমদানিতে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে।

বর্তমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পেক্ষাপটে আমদানি কমাকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘মঙ্গল’ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে এটারই খুব দরকার ছিল। আমদানি কমলে ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি খাতে খরচ বাড়তে থাকে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয় দেশে, যা ছিল আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।

আগস্টে তা এক লাফে বেড়ে ৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় ৭৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে আমদানি হয় ৬ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগের বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি হয় ৬২ দশমিক ৫২ শতাংশ; খরচ হয় ৬ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।

নভেম্বরে আমদানি ব্যয় ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে বেশি খরচ হয় ৬৩ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পণ্য আমদানিতে ৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসের হিসাবে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি ব্যয়; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয় ৪৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

মার্চে আগের বছরের মার্চের চেয়ে আমদানি খাতে বেশি খরচ হয় ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ; আমদানি হয় ৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এপ্রিলে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয় ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

সর্বশেষ মে মাসে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।

২০২১ সালের মে মাসে ব্যয় হয়েছিল ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

আকুর বিলও কমছে

আমদানি ব্যয় কমার তথ্য এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিলেও পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার আকুর মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর আগে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের আকুর দেনা পরিশোধ করা হয়েছিল। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের বিল শোধ করা হয় ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

মে-জুন মেয়াদের আকুর বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে সবাই আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের জোয়ারের কারণে সেটা আর হয়নি। বৃহস্পতিবার আকুর ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরই অবস্থান করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে (১ থেকে ৬ জুলাই) ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গড়ে প্রতিদিন এসেছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে (১ থেকে ৫ জুলাই) এসেছিল ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৬ জুলাই বুধবার এক দিনেই এসেছে ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এর আগে কোনো ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি। ঈদের ছুটির আগে বৃহস্পতিবার ব্যাংক খোলা ছিল। ওইদিনের তথ্য ঈদের ছুটির পর পাওয়া যাবে।

ওইদিন রেমিট্যান্স আরও বেশি এসেছে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা।

গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরছে

আমদানি কমা এবং ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রোববার দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপন হবে। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশুসহ প্রয়োজনীয় অন্য কেনাকাটা করতে অন্যান্য বারের মতো এবারও পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। সে কারণেই রেমিট্যান্সে এই উল্লম্ফন হয়েছে।

‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি ঈদের পর মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’

‘ঈদের পর রেমিট্যান্সপ্রবাহ হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু আমদানি ব্যয় যেভাবে কমছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই; অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।’

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমদানি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারাবাহিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে বেশ কিছু পণ্যের আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। সেসবের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।’

আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৭ এপ্রিল। ওইদিন এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এরপর ১০ মে বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করে আরেকটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সার্কুলারে বলা হয়, সকল ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।

সর্বশেষ গত ৫ জুলাই আরও কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক সামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে এখন থেকে ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণসুবিধা পাবেন না আমদানিকারকরা।

এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে, এর আগে যা ছিল ৭৫ শতাংশ।

রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নেয় সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।

এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানি খরচ কমছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে গেছে; বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। এ কারণে আমদানিতে খরচ বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছে।

‘উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম আমদানি করেছিলেন। এসব কারণে আমদানি খরচ বেড়ে গিয়েছিল। এখন কমতে শুরু করেছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল হবে। ডলারের বাজারেও স্বস্তি ফিরে আসবে।’

এ বিভাগের আরো খবর