মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ১০ লাখ (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাটির দর। দুর্বল হচ্ছে টাকা।
এদিকে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেশ কমে এসেছে। বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য ওপরে অবস্থান করছে।
ঈদকে সামনে রেখে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের জোয়ারের কারণে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে (১ থেকে ৬ জুলাই) ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গড়ে প্রতিদিন এসেছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
রেমিট্যান্সে এই উল্লম্ফন না হলে আকুর দেনা শোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসত বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত এক সপ্তাহ ধরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায় বিক্রি হলেও ব্যাংকগুলো এর চেয়ে ৩/৪ টাকা বেশি দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে আমেরিকান ডলারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজী ভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, বাজারে তার চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এনেছে ৯৬ থেকে ৯৭ টাকায়, আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে ৯৬ থেকে ৯৭ টাকা দামে। খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৭ থেতকে ৯৮ টাকার মধ্যে। মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বৃহস্পতিবার ৯৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৭ টাকায়।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে শুরু করে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ছিল ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ১১ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১০ দশমিক ২৪ শতাংশ।