বাজেট পাসের পর দুই দিন পতনের পর ঘুরে দাঁড়ানো পুঁজিবাজারে এক দিন পরেই আবার দরপতন হলো। বেশিরভাগ কোম্পানির দরপতনের পাশাপাশি কমে গেছে লেনদেনও।
বুধবার লেনদেনের শুরুতেই সূচক বেড়ে গেলেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে তা কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ৩৬৬ পয়েন্টে।
অন্যদিকে লেনদেন আগের দিনের চেয়ে ২১৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪৬ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকায়।
আগের দিন লেনদেন হয় ৯৬০ কোটি ৭৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা, যা ১৩ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
নতুন বছর শুরু হতে না হতেই আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাপ্রবাহ, ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ইত্যাদি ইস্যুতে টালমাটাল পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশ্বাস দেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নতুন বছরে বাজারে নতুন ফান্ড ইনজেক্ট হয়। বাজারে তারল্য বাড়ে।
তবে অর্থবছরের প্রথম সপ্তাহে তেমনটা দেখা যায়নি। পতনমুখি বাজারে গতকাল ইউটার্ন এলেও একদিন পরে আবারও আগের ধারায়।
বুধবার যতগুলো শেয়ারের দাম বেড়েছে কমেছে তার প্রায় দ্বিগুণ। ১১৮টি শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২১০টির। অপরিবর্তিত দামে লেনদেন হয়েছে ৫৪টি কোম্পানির শেয়ার।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
লেনদেনের বিষয়ে এক্সপো ট্রেডার্সের প্রধান নির্বাহী শহিদুল হোসেন বলেন, ‘ঈদের আগে বাজার খুব বেশি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গতকাল দর বেড়েছিল, আজকে হয়তো অনেকেই লাভ দেখেছেন সেটা বিক্রি করেছেন। তাই সূচক কিছুটা কমেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগে মানুষের টাকার প্রয়োজন পড়ে, সেটা বিগত কয়েক দিনে তুলে ফেলেছে। বাকি যে টাকা অ্যাকাউন্টে ছিল তা দিয়ে কেনাবেচা করছে।গতকাল কিনেছিল, আজকে লাভ পেয়ে বিক্রি করেছে।’
শহিদুল হোসেন বলেন, ‘ঈদের পরে আশা করা যেুতে পারে যে, নতুন বিনিয়োগে বাজার আবার চাঙা হবে।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ দর বেড়েছে গতকাল তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। আগের দিন ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩৬ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল। আজকে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে ১৫০ টাকা ১০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে।
৮ মাস আগেও বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে শেয়ার লেনদেন হতে দেখা গেছে। গত বছরের ১৮ নভেম্বর শেয়ারটির দর উঠেছিল ২৩২ টাকা ৯০ পয়সা।
ডিএসইর ওয়েবসাইটে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন-সংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত তথ্য নেই। ২০১৮ সালের পরে আর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি।
দর বৃদ্ধির দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি। দেশজুড়ে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে কোম্পানিটির শেয়ারদর।
৮ দশমিক ১৮ শতাংশ দর বেড়ে প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩০ টাকা ৪০ পয়সায়। ২০১৬ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের ধারাবাহিকভাবে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে কোম্পানিটি।
২০২১ সালে শেয়ার প্রতি ৮৭ পয়সা আয়ের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানি।
দর বৃদ্ধির তৃতীয় স্থানে রয়েছে লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেড। ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৮৭০ টাকা ৩০ পয়সায়। গতকাল সর্বশেষ দর ছিল ৮০৯ টাকা ৬০ পয়সা।
মাত্র ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি প্রতি বছরই আয় করেছে। ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ছাড়া সবগুলোই নগদ।
দর বৃদ্ধির তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং স্টেশন। আয় কম হলেও প্রতি বছরই মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।
২০২১ সালে ৮১ পয়সা আয়ের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে ২ শতাংশ। তার আগের বছর ৫ এবং ২০১৮ সালে ৫ শতাংশ করেই লভ্যাংশ দিয়েছে।
কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে ২৬ জুন থেকে। ওই দিন ২০ টাকা ৩০ পয়সা দরে লেনদেন হওয়া শেয়ারটির দর আজকেই বেড়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকা ১০ পয়সা।
এর পরেই ওইমেক্স ইলেক্ট্রোড লিমিটেডের। ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ দর বেড়ে সর্বশেষ ২০ টাকাক ৮০ পয়সায় প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
কোম্পানির আর্থিক তথ্য বলছে, প্রত বছরই সামান্য পরিমাণে মুনাফায় থাকলেও কোনোদিন নগদ লভ্যাংশের মুখ দেখেননি এর বিনিয়োগকারীরা। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে ওইমেক্স।
তালিকার দশে স্থান পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে এর পরের স্থানে রয়েছে যথাক্রমে জেনেক্স ইনফোসিস, লোকসানি জাহিদ স্পিনিং লিমিটেড, এএফসি অ্যাগ্রো, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এবং প্রাইম টেক্সটাইল।
দরপতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর পতন হয়েছে লোকসানি জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেডের। সর্বোচ্চ সীমা অর্থাৎ ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ দর পতনের মাধ্যমে শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ১৮১ টাকা ৫০ পয়সা।
১৯৮৮ সালে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানিটি কোনো দিন লাভের মুখ দেখেনি। লভ্যাংশ জোটেনি বিনিয়োগকারীদেরও। তবে কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপক ওঠানামা করে। ২৬ জুন ১৬৫ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেনের পরে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৪ জুন পর্যন্ত। এরপর দুই কর্মদিবস কমল।
দর পতনের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস। একই সমান দর কমে সর্বশেষ ৫২০ টাকা লেনদেন হয়েছে কোম্পানির শেয়ার।
ধারাবাহিকভাবে মুনাফা থাকা কোম্পানিটি ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ৪২ পয়সা লোকসান গুনেছে। ফলে লভ্যাংশ পাননি বিনিয়োগকারীরা। তবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
সমান দর কমে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার ৪০ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৩৯ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
ক্রাউন সিমেন্টের দর ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ কমে ৭৪ টাকায় লেনদেন হয়েছে।
দর পতনের পঞ্চম অবস্থানে থাকা লোকসানি মেঘনা পেটের দর কমেছে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শেয়ারের সর্বশেষ দর ছিল ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা।
সপ্তম স্থানে রয়েছে সাভার রিফ্যাক্টরিজ। ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর কমে শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ২৩৮ টাকা ৬০ পয়সায়।
লোকসানে ডুবে থাকা এক কোটি ৩৯ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি কোনো দিনই বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
দরপতনের শীর্ষ দশে রয়েছে যথাক্রমে আমান কটন, শ্যামপুর সুগার মিলস, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ ও নিউ লাইন ক্লোথিং লিমিটেড।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ৬ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট সূচক কমেছে রবির দরপতনের কারণে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক শূন্য ৮৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ দশমিক শূন্য ১ পয়েন্ট কমিয়েছে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের দর ২ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ২ দশমিক ২২ পয়েন্ট।
এ ছাড়া তিতাস গ্যাস, পাওয়ার গ্রিড, বিএসআরএম, বিকন ফার্মা, বার্জার পেইন্টস, রেনাটা ও র্যাক সিরামিকসের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০ কোম্পানি কমিয়েছে ১৭ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট।
বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৫০ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে গ্রামীণফোন। এদিন কোম্পানিটির দর শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
সূচকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট যোগ করেছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। দর ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৩ পয়েন্ট।
খুলনা পাওয়ার সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এ ছাড়া ওয়ালটন হাইটেক, জেনেক্স ইনফোসিস, বেক্সিমকো ফার্মা, সোনালী পেপার, শাহজীবাজার পাওয়ার, স্কয়ার ফার্মা, রেকটি বেনকিজার সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট।